আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা এবং শাসনাকল (১০৫৫-১১১৮খ্রি.)। বুয়াইয়া রাজবংশের অধিনে আব্বাসীয় খেলাফত। Family tree of Abbasid Caliph 1055-1118 AD.
১০৩১ খ্রি. ইসলামের ইতিহাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ঘটনাসমূহ হলো যথাক্রমে স্পেনে উমাইয়া খেলাফতের পতন, আফগাস্তানের গজনী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও শ্রেষ্ঠ শাসক সুলতান মাহমুদ গজনবীর মৃত্যু এবং সুন্নি আব্বাসীয় খেলাফতের উপর প্রভাব বিস্তার কারী, শিয়া পন্থি বুয়াইয়া রাজবংশের পতন এবং সুন্নি সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান। শিয়াপন্থি বুয়াইয়া যুগে আব্বাসীয়রা নামমাত্র খলিফা হিসেবে বাগদাদের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিল। এই সময় ইসলামী খিলাফতের প্রকৃত ক্ষমতা বুয়াইয়া আমিররা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। ইসলামী খিলাফতের এই দু:সময়ে অভ্যূত্থান ঘটে সেলুজক তুর্কিদের। সেলজুক তুর্কি মুসলমানরা বুয়াইয়াদের পরাজিত করে আব্বাসীয় খলিফাদের গৌরব-মর্যদা পুন:প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা-সেলজুক যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিক্যালটি সম্পূর্ণ পড়ুন। অথবা ইউটিব চ্যানেলে ভিডিও দেখতে পারেন, লিংক:আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা (১০৫৫-১১১৮খ্রি.(
১০৩১ খ্রি. খলিফা আল কাদিরের মৃত্যুর পর তার পুত্র আল কাইম বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময় আব্বাসিয় খলিফাদের কোন ক্ষমতা ছিল না। তারা নামমাত্র খলিফা হিসেবে, পারস্যের বুয়াইয়া আমিরুল উমারাদের অধিনস্ত ছিল। বুয়াইয়ারা আব্বাসীয় খলিফাদের পরিবর্তে, মিশর ও উত্তর আফ্রিকার, ফাতেমী শাসকদের খলিফা হিসেবে মান্য করতো। তবে শেষ বুয়াইয়া আমিরুল উমারা মহিউদ্দৌল্লাহর শাসনমালে, বুয়াইয়াদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পাই।
আরও পড়ুন:
*রাশেদীন খলিফাদের বংশ তালিকা (৬৩২-৬৬১ খ্রি.)
* উমাইয়া খলিফাদের বংশ তালিকা (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
*আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা (৭৫০-৮৪২ খ্রি.)
*আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা (৮৪২-৯৪৪ খ্রি.)
*আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা (৯৪৪-১০৫৫ খ্রি.)
অত:পর খলিফা আল কাইম, শিয়াপন্থি বুয়াইয়াদের কুঃশাসন ও প্রভাব
থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে, ১০৫৫ খ্রি. সেলজুক আমির তুঘ্রিল বেগকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান। তুঘ্রীল বেগ পারস্যের রাই শহরকে রাজধানী
করে, পারস্য, মধ্য এশিয়া, খোরাসান এবং আফগানিস্তানে বৃহৎ সেলজুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা
করেন। খলিফা আল কাইমের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে,
তুঘ্রীল বেগ ১০৫৫ খ্রি. বাগদাদে অভিযান পরিচালনা করে, বুয়াইয়া শাসনের পতন ঘটায়।
বুয়াইয়াদের পতনের মাধ্যমে, একদিকে
বাগদাদের সুন্নি আব্বাসীয় খিলাফতের মর্যদা
এবং গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে মিশর ও উত্তর আফ্রিকার, শিয়া পন্থি ফাতেমী খিলাফতের
ক্ষমতা হ্রাস পাই। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ খলিফা আল কাইমও, তুঘ্রীল বেগকে সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর থেকে ইসলামী খিলাফত কিংবা মুসলিম
বিশ্বের রক্ষাকর্তা হিসেবে, সেলজুক সুলতানরা শাসনকারয পরিচালনা করে। ১০৬৪ খ্রি. সুলতান তুগ্রীল বেগের মৃত্যুর পর,
তার ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ আল্প আরসালান সেলজুক সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হন। সুলতান আল্প আর্সলানের শাসনকালে সেলজুক
সাম্রাজ্যে সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে।
১০৭৫ খ্রি. খলিফা আল কাইমের মৃত্যুর পর, তার পুত্র মুকতাদির আব্বাসীয় খিলাফতের,
নতুন খলিফা হিসেবে বাগদাদের সিংহাসন আরোহণ করেন। তার শাসনকালে সেলজুক শাসক ছিলেন- মালিক শাহ। মালিক শাহকে বলা হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের
শ্রেষ্ঠ শাসক। তার রাজত্বকালে সেলজুক সাম্রাজ্যে, গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করে। এই সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা ছড়ানোর মাধ্যমে
ইসলামী সভ্যতা এক নতুন দীগন্ত স্থপিত হয়।
খলিফা মুকতাদিরও মালিক শাহের রাজত্ব
কালে, স্বাধীনভাবে খেলাফতের দায়িত্বপালন করতে সক্ষম হন। কেননা সেলজুক সুলতানরা যথই ক্ষমতাবান
এবং প্রভাবশালী হোক না কেন, তারা মুসলিম জাহানের খলিফাকে সর্বদা সম্মান ও মান্য করতো। ১০৯৪ খ্রি. খলিফা মুকতাদিরের মৃত্যুর পর, তার
পুত্র মুসতাজির বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আরও পড়ুন:
*স্পেনের উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস
খলিফা মুসতাজিরের খেলাফতকালে ১০৯৪ খ্রি. সেলজুক শাসক মালিক শাহ মুত্যু বরণ করেন। মালিক শাহের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতার দখলকে কেন্দ্র করে, গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যজুড়ে অরাজকতা ও বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সেলজুক সাম্রাজ্যের বিচছৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা এবং আব্বাসীয় খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে, খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপের নেতৃত্বে ইউরোপের ক্ষুধার্থ, ধর্মান্ধ ও লোভী খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা, পবিত্র শহর জেরুজালেম দখলের নাম করে, ধন-সম্পদ লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে, মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
১০৯৭ খ্রি. তারা মুসলিম শহর আনাতোলিয়া এবং এন্টিয়ক আক্রমণ করে, সেখানকার হাজার হাজার মুসলিম অধিবাসিক হত্যা করে। এরপর ক্রুসেডাররা ১০৯৯ খ্রি. মুসলিম শহর জেরুজালেম দখল করে, সেখানকার প্রায় ৭০ হাজার মুসলিম নর-নারীর উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইসলামের তৃতীয়তম পবিত্র মসজিদ আল আকসাকে তারা গীর্জায় রুপান্তর করে। জেরুজালেমের দখলের পর, তারা আলেপ্পা, এডিসা, ত্রিপোলি, হাইফা, জাফা ইত্যাদি মুসলিম শহর দখল করে এবং একইভাবে সেখানকার অধিবাসিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
জেরুজালেমের পতনের পর, কিছু মুসলিম পালিয়ে বাগদাদে গমন করে, খলিফা মুসতাজিরকে জেরুজালেমের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করেন। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফার মুসতাজিরের এমন কোন ক্ষমতা ছিল না যে, তিনি শক্তিশালী ক্রুসেডারদের পরাজিত করে, জেরুজালেমসহ হারানো শহরগুলো পুনরুদ্ধার করবেন। মুসলমানদের এমন দুরস্থার কথা শুনে, মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, অশ্রু বিসর্জন ব্যাতিত তার আর কোন উপায় ছিল না।
তাছাড়া মুসলমানদের এই দুঃসময়ে, ইসলামী
বিশ্ব ও খিলাফতের রক্ষক, সেলজুক সুলতান বারকিয়ারুক এবং মাহমুদ সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র
করে, গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে একসময়ের পরাশক্তি সেলজুক সাম্রাজ্যও দুর্বল হতে থাকে।
এভাবে খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের আক্রমণে যখন, মুসলিম বিশ্ব পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল,
তখন ১১১৮ খ্রি. খলিফা আল মুসতাজির মৃত্যু বরণ করেন। খলিফা মুসতাজিদের মৃত্যুর পর, তার
পুত্র মুসতারশিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আরও পড়ুন:আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা ও শাসকাল (৯৪৪-১১১৮ খ্রি.)
অন্যদিকে একই বছর সেলজুক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন, শেষ শ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান আহমেদ সেনজার। সুলতান আহমেদ সেনজার শক্তিশালী হলেও, নিজের সাম্রাজ্যের গৃহ বিবাদের কারণে মুসলিম বিশ্ব কিংবা জাতীর জন্য, তিনি তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন নি। মুসলিম জাতীর এই দুঃসময়ে আভির্ভাব ঘটে, আমির ইমাম উদ্দীনের নেতৃত্বে জেঙ্গি এবং সুলতান সালাউদ্দীনের নেতৃত্বে আয়ুবিদ রাজবংশের। এই দুই রাজবংশের শাসকেরা যথাক্রমে, মুসলমানদের হারানো রাজ্য এবং ইসলামী খেলাফতের গৌরব পুনরুদ্ধার করে।
✏️তথ্যের উৎস:
📘ইসলামের ইতিহাস- সৈয়দ মাহমদুল হাসান 📘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি- সৈয়দ মাহমুদুল হাছান 📘ইসলামের ইতহিাস- মুহাম্মদ মিজানুর রশিদ 📘আরব জাতীর ইতিহাস- শেখ লুতফর রহমান 📘দ্যা লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি- ফিরাস আল খতিব 📘উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস - ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লবী
📘 উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবসাইট
0 মন্তব্যসমূহ