আব্বাসি খিলাফতের ইতিহাস। Abbasid Caliphate

 ইসলামের তৃতীয় খিলাফত আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস । আব্বাসি খিলাফতের উত্থান ও পতনের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানোন । A Brief History of Abbasid Caliphate .

                                                         

আব্বাসীয় খিলাফত

আব্বাসীয় খেলাফত ছিল, ইসলামের তৃতীয় খেলাফত। রাজ্য বিজয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায়, এই খিলাফতকে ইসলামের ইতিহাসের, স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর উত্থান হওয়ার আব্বাসীয় খেলাফত ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যযন্তর দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছরর মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলের এই খেলাফতের পতন ঘটলেও, ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তর আব্বাসীয় খলিফারা মিশরের মামলুক সুলতানতের অধীনের মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এরপর ইসলামী খেলাফতের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়,  উসমানীয় তুর্কি সুলতানদের উপর।

আব্বাসীয় খিলাফতের উত্থান ও পতন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিক্যালটি সম্পূর্ণ পড়ুন।

৭৪৯ খ্রি. ৩০ অক্টোবর রোজ বৃহস্পতিবার, উমাইয়া শাসনে অতিষ্ঠিত হয়ে, হাশেমী গোত্রের অন্যতম একটি শাখা, আব্বাসীয়গণ তাদের নেতা আবুল আব্বাসকে, কূফার জামে মসজিদে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে। প্রসঙ্গত মহানবীর (স) চাচা আব্বাসের বংশধররা, আব্বাসীয় হিসেবে পরচিত। আবুল আব্বাসের খলিফা ঘোষিত হওয়ার সংবাদ শুনে, শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান বিচলিত হয়ে পড়েন। অত:পর লক্ষাধিক সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে, আব্বাসীয়দের দমনের উদ্দেশ্যে কুফার দিকে যুদ্ধ যাত্রা করে।

অত:পর ৭৫০ খ্রি., টাইগ্রীস নদীর অববাহিকায়, জাব নদীর তীরে উমাইয়া ও আব্বাসীয় বাহিনীর মধ্যে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি জাবের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান, আব্বাসীয়দের নিকট পরাজিত ও নিহত হয়। মূলত তার পরাজয়ের মাধ্যমে, উমাইয়া রাজবংশ বা খেলাফতের পতন ঘটে এবং আবুল আব্বাসের খলিফা হওয়ার মধ্যদিয়ে, আব্বাসীয় খিলাফত বা রাজবংশের উত্থান হয়। 

পড়ুন:উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস

খিলাফত লাভের পর আবুল আব্বাস, দামেস্ক থেকে কুফার নিকটে অবস্থিত  আনবার শহরে, আব্বাসীয় খিলাফত তথা ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। এরপর তিনি উমাইয়াদের কঠোর হস্তে দমন করেন। উমাইয়াদের উপর তার পরিচালিত অত্যাচারের কারণে, তাকে আস সাফফাহ বা রক্তপিপাসু উপাধীতে ভুষিত করা হয়। 

তবে উমাইয়া খলিফা হিশামের পৌত্র, যুবরাজ আব্দুর রহমান স্পেনে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং তিনি পরবর্তীতে স্পেনে, স্বাধীন উমাইয়া আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৫৪ খ্রি. আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম খলিফা, আবুল আব্বাস আস সাফফার মৃত্যুর পর, তার ভ্রাতা আবু জাফর “আল মনসুর বা বিজয়ী উপাধি ধারণ করে, বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ৭৬২ খ্রি. আনবার থেকে বাগদাদে রাজধানী স্থানান্তর করেন। 

তিনি রাজ্যের বিদ্রোহ দমন, রাজ্য বিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রেখে, আব্বাসীয় রাজবংশকে, শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তাই খলিফা আবু জাফরকে, আব্বাসীয় খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার শাসন আমলে ৭৫৬ খ্রি., পালাতক উমাইয়া যুবরাজ আব্দুর রহমান আদ দাখিল, স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা আল মনসুর স্পেন থেকে উমাইয়াদের বিতাড়ন করে, আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, উত্তর আফ্রিকার শাসক আল মুগীসের নেতৃত্বে, স্পেনে উমাইয়াদের বিরোদ্ধে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন।

কিন্তু এই যুদ্ধে উমাইয়াদের কাছে, আব্বসীয় বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। অত:পর আব্দুর রহমান আব্বাসীয় সেনাপতির ছিন্ন মস্তক, খলিফার কাছে প্রেরণ করলে, তিনি বিস্মিত হয়ে যান এবং আব্দুর রহমান আদ দাখিলকে, ফ্যালকন অব দ্যা আরব বা আরবদের বাজপাখি উপাধীতে ভূষিত করেন। এমনকি এর পর, আর কোন আর কোন আব্বাসীয় খলিফা, স্পেন বিজয়ের সাহস করেনি।

৭৭৫ খ্রি. খলিফা আবু জাফর আল মনসুরের মৃত্যুর পর, তার পুত্র আল মাহাদী সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ৭৭৫ খ্রি. থেকে ৭৮৫ খ্রি. ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ভন্ডনবী মোকান্না ও পথভ্রষ্ট জিনদীক সম্প্রদায়কে দমন এবং বায়জান্টাই আক্রমণ প্রতিহত করে, আব্বাসীয় খেলাফতকে সুসংহত করেন। ৭৮৫ খ্রি, খলিফা আল মাহদীর মৃত্যুর পর, তার জৈষ্ঠ্য পুত্র আল হাদী, খেলাফতের দায়িত্বলাভ করেন। কিন্তু ৭৮৬ খ্রি. খলিফা আল হাদীর আকস্মিক মৃত্যুর পর, তার ভ্রাতা হারুনুর রশীদ খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

পড়ুন: রাশেদনী খিলাফতের ইতিহাস

খলিফা হারুনুর রশীদ, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিদ্রোহ দমন করে, আব্বাসীয় খেলাফতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি রোমান বায়জান্টাইন সম্রাট নাইসিফোরাসকে ৩ বার পরাজিত করার পরও, প্রতিবার ক্ষমা করে ইতিহাসে ক্ষমাশীল হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার শাসন আমলে, বাগদাদ পৃথিবীর সেরা নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এমনকি বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস আলিফ লায়লা, এই বাগদাদকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। খলিফা হারুনুর রশিদ সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ দমন, রাজ্য বিজয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-গবেষণার উন্নয়নের মাধ্যমে, ইসলামের স্বর্ণযুগের সূচনা করেন। 

ইসলামের ইতিহাসের এই মহান খলিফা ৮০৯ খ্রি. মৃত্যু পথের যাত্রী হন। তার মৃত্যুর পর, জৈষ্ঠ্যপুত্র আল আমীন বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ৮০৯ থেকে ৮১৩ খ্রি, শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। ৮১৩ খ্রি. খলিফা আল আমীনের মৃত্যুর পর, আল মামুন বাগদাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

খলিফা আল মামুনের শাসনকাল, আব্বাসীয় খিলাফতের এক গৌরবময় যুগ। তিনি নিজেও একজন বিদ্বান শাসক ছিলেন। ৮৩০ খ্রি. জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়ার জন্য, তিনি বায়তুল হিকমা বা House of Wisdom প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, জ্ঞানি পিপাসুরা এই শিক্ষা নিকেতনে, জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আগমন করতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার কারণে, খলিফ আল মামুনের শাসনকালকে, ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

৮৩৩ খ্রি. খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর পর, মু’তাসিম বিল্লাহ আব্বাসীয় বংশের ক্ষমতায় আসীন হন। খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহকে, আব্বাসীয় খেলাফেতের শেষ শক্তিশালী, খলিফা হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কারণ তার পরবর্তী খলিফারা অন্য কোন রাজবংশ, কিংবা সালতানাতের অধীনে, নামেমাত্র খলিফা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। খলিফা মু’তাসিম নিজ সৈন্যবাহিনীর, আরব ও পারসিক সৈন্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য, মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ, বুখারা, নিশাপুর, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে, হাজার হাজার নওমুসলিম তুর্কি যুবক এনে, একটি বিশাল তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন।

পড়ুন:আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা

প্রথমদিকে খলিফা মু’তাসিম, এই তুর্কি বাহিনী নিয়ে, সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ ও বিচ্ছৃঙ্খলা দমন করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তীতে এই বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা, লুন্ঠন ও অত্যাচারের কারণে, তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সমৃদ্ধ নগরী, বাগদাদের জনজীবন অতিষ্ট হয়ে পড়ে। তাই খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ বাধ্য হয়ে, ৮৩৬ খ্রি. আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নগরী বাগদাদ থেকে, ৬০ মাইল উত্তরে সামারা নামক শহরে স্থানন্তর করেন। এই নগর দীর্ঘ ৫৬ বছর অর্থাৎ ৮৩৬ থেকে ৮৯২ খ্রি. পর্যন্ত, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বিবেচিত ছিল।

অত:পর ৮৪২ খ্রি,. খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর মৃত্যুর পর, তুর্কী দেহরক্ষীরা, আব্বাসীয় খিলাফতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। তারা আমীরুল উমরা উপাধী ধারণ করে, ৮৪২ খ্রি. থেকে ৯৪৪ খ্রি. পর‌্যন্ত, দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছর, ১৪ জন দুর্বল আব্বাসীয় খলিফার প্রতিনিধিত্ব করে। এই সময় খলিফারা ছিল, তাদের হাতের ক্রিড়ানক, তারা যাকে ইচ্ছে সিংহাসনে আরোহণ করাত এবং যাকে ইচ্ছে পদচ্যুত করত। 

আব্বাসীয় খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে, এ সময় ইসলামী বিশ্বে ৩ টি খিলাফতের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয় খিলাফত ব্যাতিত অপর দুইটি খিলাফত হলো, উত্তর আফ্রিকা ও মিশরের ফাতেমী এবং স্পেনের উমাইয়া খিলাফত। অত:পর ৯৪৪ খ্রি. খলিফা ‍মুসতাকফি বিল্লাহ, তুর্কি আমির-উমরা ও সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, তাদের থেকে চিরতরে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে, তৎকালীন পারস্যের শিয়া পন্থি বুয়াহিদ রাজবংশের, আমির মুইযউদ্দৌল্লাহকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান।

বুয়াহিদ আমির মুইযউদ্দৌলাহ ৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে, সসৈন্য নিয়ে বাগদাদে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে, তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীকে পরাজিত করে , ‍তুর্কি বাহিনী ও আমির  উমরার শাসনের অবসান ঘটান এবং বাগদাদে বুয়াহিদ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, শিয়াপন্থি বুয়াহিদ রাজবংশকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে, আব্বাসীয় খলিফা মুসতাকফি বিল্লাহ মূলত খাল কেটে কুমির এনেছিল।

কেননা তুর্কিদের পতনের পর, আব্বাসীয় খলিফার দুর্বলতা ও অক্ষমতার সুযোগে, আমির মুইযউদ্দোল্লাহ, বাগদাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। মুসতাকফিকে নামমাত্র খলিফা রেখে, উচ্চভিলাসী মুইজউদ্দোল্লাহ খলিফার সকল ক্ষমতা, হস্তগত করে এবং তাকে সুলতান উপাধী দান করতে খলিফাকে বাধ্য করে। এভাবে ৯৪৪ থেকে ১০৫০ খ্রি. দীর্ঘ ১০০ বছর প্রায় ৫ জন আব্বাসীয় খলিফা, নামমাত্র খলিফা হিসেবে বাগদাদের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিল।


তুর্কি আমির উমরাদের মত বুয়াহিদরাও, আব্বাসীয় খলিফাদের, নিজেদের ইচ্ছে মত সিংহাসন আরোহণ এবং সিংহাসনচ্যুত করত। এমনকি তারা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠে যে, খুৎবা এবং মুদ্রায় খলিফার নামের পাশাপাশি, তাদের নামও উচ্চারিত এবং অঙ্কিত হত। তাছাড়া শিয়াধর্মমতালম্বি বুয়াহিদরা, সুন্নি আব্বাসীয় খলিফাদের পরিবর্তে, মিশরের শিয়াপন্থি ফাতেমী খলিফাদের আনুগত্য করত। 


এভাবে শিয়া মতলম্বি বুয়াহিদ শাসকদের দাপড়ে, যখন আব্বাসীয় সুন্নি খলিফাদের, গৌরব ও মরযদা বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন পারস্যের আল রাই শহরে, তুঘ্রীল বেগের নেতৃত্বে উত্থান হয়, শক্তিশালী সেলজুক তুর্কি সাম্রাজ্যের। নও মুসলিম ধর্মপ্রাণ সেলজুক তুর্কিরা, সুন্নি মতের অনুসারী ছিল। তারা পারস্য, খোরাসান, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান এবং এশিয়া মাইনরে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

পড়ুন:সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস


বুয়াহিদদের কু:শাসন ও অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে, তাদের থেকে পরিত্রাণের জন্য, আব্বাসীয় খলিফা কায়িম বিল্লা, সেলজুক সাম্রাজ্যের অধিপতি তুঘ্রীল বেগকে আমন্ত্রন জানায়। ১০৫৫ খ্রি, তুঘ্রীল বেগ, সৈসন্যে বাগদাদে যুদ্ধ অভিযান চালিয়ে, বুয়াহিদ আমির মুুইজ উদ্দৌল্লাহ ও সেনাপতি বাশাশিরিকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে, তাদের থেকে বাগদাদ পুনরুদ্ধার করেন। এর মাধ্যমে তিনি আব্বাসীয় খলিফা এবং ইসলামী খিলাফতের, গৌরব ও সম্মান ফিরিয়ে আনেন। এতে খলিফা কায়িম বিল্লাহ খুশী হয়ে, তুঘ্রীল বেগকে প্রাচ্য ও প্রাতিচ্যের স্বাধীন সুলতান উপাধিতে ঘোষিত করেন।


১০৫৫ থেকে ১১৬০ খ্রি. পরযন্ত দীর্ঘ ১০০ বছর, ৭ জন আব্বাসীয় খলিফা সেলজুক সুলতানদের, সহযোগিতা ও সমর্থনে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করে। সেলজুক সুলতানরা খলিফাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং মান্য করত। ১১৬০ খ্রি. শেষ শ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান, আহমেদ সানযারের মৃত্যুর পর, খলিফা মুকতাযীরের খেলাফতকালে, আব্বাসীয় খিলাফতের উপর সেলজুক আধিপত্যর পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও এ সময় বৃহৎ শক্তিশালী সেলজুক  সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে।



এই আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনামলে, ১০৯৫ খ্রি. সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ক্রুসেড যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছিল ইসলাম কিংবা বিশ্ব ইতিহাসের, মোড পরিবর্তনকারি ঘটনা, ১০৯২ খ্রি. শ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান, মালিক শাহের মৃত্যুর পর, তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে, গৃহ যুদ্ধের সূচনা হয়। তাছাড়া তখনকার আব্বাসীয় খলিফারাও ছিল দুর্বল ও ক্ষমতাহীন। মুসলিম বিশ্বের এমন বিচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপের নেতৃত্বে, ক্ষুধার্থ ও ধর্মান্ধ ক্রুসেড নরপিশাচরা, ইউরোপ থেকে প্রথমে এশিয়া মাইনর এরপর আরবে প্রবেশ করে।


অত:পর এই ক্রুসেড নরপশুরা, মুসলিম শহর এডিসা, এন্টিয়ক, জাফা, হাইফা, বৈরুত, ত্রিপোলি এবং জেরুজালেম দখল করে, স্থানীয় ‍মুসলমানদের উপর গণ হত্যা চালায়। মুসলমানদের এই বিপরযয়ে, সেলজুক সুলতান কিংবা আব্বাসীয় খলিফা, কেউ খ্রিস্টানদের বিরোদ্ধে ‍রুখে দাড়িয়ে, মুসলমানদের রক্ষা করতে পারেন নি। মুসলমাদের এমন বিপরযয়ে, আবির্ভাব ঘটে বীর সেনানী গাজী সালাউদ্দীন আয়ুবির। 

পড়ুন:মহানবীর (স) বংশ তালিকা


তিনি ১১৭৮ খ্রি. ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করে, ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান জেরুজালেম সহ, মুসলমানদের হারানো নগর সমূহ পুনরুদ্ধার করেন।  তিনি শিয়াপন্থী ফাতেমী খিলাফতের পতন ঘটিয়ে, মুসলিম বিশ্বের জন্য একমাত্র খিলাফত হিসেবে, আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। ১১৯৩ খ্রি এই মহান বীর সেনানায়কের গৌরবময় জীবনের অবসান হয়। ১১৬০ থেকে ১১৯৩ খ্রি. গাজী সালাউদ্দীন আয়ুবির মৃত্যুর পরযন্ত মোট ৯ জন, এরপর ১১৯৩ খ্রি, থেকে ১২৫৮ খ্রি বাগদাদ কেন্দ্রীক আব্বাসীয় খিলাফতের পতন পর‌্যন্ত, আরও ৪ জন আব্বাসীয় খলিফা, ইসলামী বিশ্বকে নেতৃত্বে প্রদান করে।


শেষের আব্বাসীয় খলিফারা ছিল সবেচেয় দুর্বল এবং ক্ষমতাহীন। তারা সবাই নামমাত্র খলিফা হিসেবে, খেলাফতের দায়িত্বে ছিল। মূলত এ সময় ইসলামী বিশ্বের প্রকৃত নেতৃত্বে ছিল, মিশর ও সিরিয়ার মামলুক সালতানাত, মধ্য এশিয়ার খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য, আফগানীস্তানের ঘুরি সাম্রাজ্য কিংবা ভারতবর্ষের দিল্লির সালতানত। যাই হোক ১২২৫ আব্বাসীয় খলিফা জাহিরের খেলাফতকালে, দুর্ধর্ষ মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খান, মধ্য এশিয়ার শক্তিশালী খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। মঙ্গোলদের আক্রমণে তৎকালীন সমকরন্দ, বুখারা, নিশাপুর সহ, তৎকালীন সমৃদ্ধ বহু মুসলিম শহর, নরকে পরিণত হয়। এবং মুসলমানদের উপর তারা পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।


এরই ধারাবাহিকতায় ১২৫৮ খ্রি. চেঙ্গিস খানের পৌত্র, হালাকু খানের নেতৃত্বে সাম্রাজ্য বিস্তারে মগ্ন থাকা, বিশাল মঙ্গোল বাহিনী আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ আক্রমণ করে। মঙ্গোলদের এই আক্রমণে সহেযোগিতা করেছিল, বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খেলাফতের শেষ খলিফা, মুসতাসিম বিল্লাহ’র শিয়া ধর্মমতালম্বি প্রধান মন্ত্রী, আল কামী। অত:পর খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ স্বল্প সংখ্যক মুসলিম বাহিনী নিয়ে, মঙ্গোলদের বিরোদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধে করেও পরাজয় বরণ করেন।


খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহর পরাজয়ের পর, মঙ্গোলরা বাগদাদ নগরী দখল করে, সমস্ত শহর পুড়িয়ে ধ্বংস করে এবং জনগণের উপর গনহত্যা চালায়। নরপিশাচ ও দুর্দর্ষ মঙ্গোলরা, আব্বাসীয় খলিফা, তার পরিবারবর্গ এবং অসংখ্য মুসলিম মনীষী সহ ,প্রায় ১৬ লক্ষ বাগদাদের মুসলিম নাগরিককে হত্যা করে। তারা বাগদাদের বায়তুল হিকমা গ্রন্থাগারে আগুন লাগিয়ে দেয়, ফলে ইসলামী স্বর্ণযুগের অর্জিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ ও গবেষণাপত্র সমূহ আগুনে পুড়ে ছায়ে পরিণত হয়।


এভাবে মঙ্গোলদের আক্রমণের ফলে, ৭৫০ খ্রি. আবুল আব্বাস আস সাফফাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠীত, দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে ৩৭ জন খলিফা কর্তৃক শাসিত, বাগদাদ কেন্দ্রীক আব্বাসীয় খেলাফতের পতন ঘটে। যদিও এরপরও আব্বাসীয় খিলাফাত, মিসরের মামলুক সুলতানদের ছত্রছায়, আর আড়াই শত বছর টিকেছিল। মঙ্গোলদের হত্যাঙজ্ঞ হতে, যে কয়জন আব্বাসীয় যুবরাজ ভাগ্যক্রমে বেচে ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, ৩৫ তম আব্বাসীয় খলিফা আল জাহিরের পুত্র আল মুসতানসির। 


১২৫৮ খ্রি. বাগদাদ কেন্দ্রীক আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর, মিশরের শ্রেষ্ঠ মামলুক সুলতান বাইবার্স ,মুসতানসিরকে মিশরে নিয়ে যান এবং রাজধানী কায়রুতে, খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত করান। ফলে কায়রু কেন্দ্রীক আব্বাসীয় খেলাফতের সূচনা হয়। এরপর ১৫১৭ খ্রি. পরযন্ত দীর্ঘ আড়াইশত বছর, ১৭ জন আব্বাসীয় খলিফা মামলুক সালতানাতের ছত্রছায়ায়, ইসলামী বিশ্বের খলিফা হিসেবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। 

পড়ুন:উসমানীয় খিলাফতের ইতিহাস

অত:পর ১৫১৭ খ্রি. উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিমের নিকট, শেষ মামলুক সুলতান খানসু ঘুরীরর পরাজয়ের মাধ্যমে, মামলুক সালতানাতের পতন ঘটে। মামলুক সালতানাতের পতনের পর, একদিকে মক্কা, মদীনা, জেরুজালেম সহ সমগ্র আরব দেশ, উসমানী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে কায়রু কেন্দ্রীক, শেষ আব্বাসীয় খলিফা তৃতীয় মুতাওয়াক্কিল, উসমানীয় সুলতান সেলিমের নিকট, ইসলামের খেলাফতের দায়িত্ব স্তানান্তর করেন। এর মাধ্যমে আরব আব্বাসীয় খিলাফতের চির অবসান ঘটে এবং তুর্কি উসমানীয় খেলাফতের যাত্রা শুরু হয়।


✏️তথ্যের উৎস: 📘ইসলামের ইতিহাস- সৈয়দ মাহমদুল হাসান 📘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি- সৈয়দ মাহমুদুল হাছান 📘ইসলামের ইতহিাস- মুহাম্মদ মিজানুর রশিদ 📘আরব জাতীর ইতিহাস- শেখ লুতফর রহমান 📘দ্যা লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি- ফিরাস আল খতিব 📘উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস - ড. আলী ‍মুহাম্মদ সাল্লবী 📘 উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবসাইট


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ