রাশেদীন খিলাফতের ইতিহাস। Rashidun Caliphate

ইসলামের প্রথম ও প্রকৃত খিলাফত রাশেদীন খিলাফত তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের সোনালী ইতিহাস । A Brief History of Rashidun Caliphate .

                                                             


৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (স) এর ওফাতের পর, তার প্রতিনিধি অর্থাৎ মুসলিম জাতীর খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন, হযরত আবু বকর (রা)। আবু বকর (রা) এর, খলিফা হিসেবে মনোনিত হওয়ার মধ্য দিয়ে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা খিলাফতের শাসনের সূচনা হয়। এর মাধ্যমে মহানবীর (স) ওফাতের পর ইসলামী রাষ্ট্র এবং মুসলিম জাতির নেতৃত্বের ভার পড়ে খলিফাদের উপর। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে, হযরত আবু বকর (রা) এর শাসনকাল থেকে শুরু করে, ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলী (রা) এর শাসনকাল পর‌্যন্ত, দীর্ঘ ৩০ বছরের খেলাফতকালকে, ইসলামের ইতিহাসে খুলাফায় রাশেদিন, বা রাশেদিন খিলাফতের শাসনকাল বলে অভিহিত করা হয়। রাশেদিন খিলাফত ছিল ইসলামের প্রথম সর্বজন স্বীকৃত খিলাফত। 

পড়ুন:আবু বকরের (স) খিলাফত লাভের ইতিহাস

খলিফা’ শব্দের অর্থ প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত । আর ‘খিলাফত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রতিনিধিত্ব করা বা অন্য কারো স্থানে স্থলাভিষিক্ত হওয়া। ইসলামে ‘খিলাফত’ এমন একটি শাসনব্যবস্থার নাম, যা মহান আল্লাহর বিধান ও মহানবী (স.) এর সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে রাশেদিন খিলাফত বলতে বুঝায় ন্যায়পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সঠিকভাবে পথনির্দেশপ্রাপ্ত খলিফাদের শাসনকালকে। 

রাশেদিন খিলাফতের প্রথম খলিফা হলেন, হযরত আবু বকর (রা)। তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে থেকে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পরযন্ত, খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। আবু বকর (রা) মহানবী (সা) এর ইন্তেকালের পর সৃষ্ট, বিভিন্ন বিদ্রোহ ও বিছ্চৃঙ্খলা দমন করে, ইসলামী রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্টা করেন। বিশেষ করে যাকাত অস্বীকারকারী এবং ধর্মত্যাগী ভন্ডনবীদের দমন করে, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে তিনি সক্ষম হন।

মহানবী (স) এর সময় ইসলামী রাষ্ট্র মক্কা,মদিনা, তায়েফ এবং ইয়ামেনের মধ্যে সিমাবদ্ধ ছিল। আবু বকর (রা) এর খেলাফতকালে ইরাকের তৎকালীন রাজধানী হিরা, আনবারা শহর, ইয়ামেনের হাজরামাউত, বাহারাইন এবং ওমান বিজিত হয়। আবু বকর (র) ইন্তেকালের পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ, হযরত ওমর (রা) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি প্রায় ১০ বছর ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদান করেন। 

ওমর (রা)

ওমর (রা) এর খিলাফতকে সম্প্রসারণের যুগ বলা হয়, কারণ এই সময় মুসলমানরা একদিকে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য, অপরদিকে বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজ্যসমূহ জয় করে, ইসলামের শাসনাধীন আনয়ন করে। তার খিলাফতকালে মুসলমানরা পারসিকদের পরাজিত করে মাদায়েন, কুফা, বসরা, ইস্তেকার, ইস্পাহান, ফার্স, কিরমান, তবারিস্তান, আজারবাইজান, খোরাসান, সিস্তান, মাকরান, প্রভৃত শহর জয় করে। 

অপরদিকে বায়জান্টাইন খ্রিস্টানদের পরাজিত করে সিরিয়া, জেরুজালেম, মিসর, উত্তর আফ্রিকার ত্রিপোলি ও বার্কা সহ আরও অনেক শহর ও নগর বিজয় করে। অত:পর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ওমর (রা) এর শাহাদাতের পর, উসমান (রা) ইসলামের তৃতীয় খলিফা হিসেবে মনোনিত হন। তিনি ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যন্ত খলিফা পদে অধিষ্টত ছিলেন। রাশেদিন খলিফাদের মধ্যে, তিনি সর্বোচ্চ ১২ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। হযরত উসমান (রা) খিলাফতকালকে মুসলমানরা মার্ভ, বলক, তুকারিস্তান, কাবুল, গজনী, কিরমান, সিজিস্তান, সাইপ্রাস,রোডস বিজয় করে।

পড়ুন:রাশেদীন খিলাফতের বংশ তালিকা

ওসমান (রা) খিলাফতের প্রথম ৬ বছর অর্থাৎ ৬৪৪ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পরযন্ত শান্তি, গৌরব, বিজয় এবং সমৃদ্ধির শাসনকাল হিসেবে বিবেচিত করা হলেও, পরবর্তী ৬ বছর অর্থাৎ ৬৫০-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পরযন্ত তার শাসনকাল ছিল বিচ্ছৃঙ্খল, বিদ্রোহ ও অরাজকতা পূর্ণ । মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা’র মত, কিছু পথভ্রষ্ট ও নামধারী মুসলমানদের হটকারিতা ও ষড়যন্ত্রের ফলে, উসমান (রা) এর খেলাফতের শেষের দিকে, বিচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এবং এই ভয়ঙ্খর পরিস্থিতির কারণেই, ওসমান (রা) কে শাহাদাত বরণ করতে হয়। তার শাহাদাতের মধ্যদিয়ে প্রথম বারের মত মুসলমানদের ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরে।

হযরত উসমান (রা) এর শাহাদাতের পর, আলী (রা) রাশেদিন খিলাফতের চতুর্থ এবং শেষ খলিফা হিসেবে মনোনিত হন। তার খেলাফতকালে, উসমান (রা) হত্যার তাৎক্ষণিক বিচারকে কেন্দ্র করে, মুসলমানদের মাঝে অসন্তোষের দানা বাধতে থাকে। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কারণে, আলী (রা) এর পক্ষে তাৎক্ষনিক বিচার কাজ আরম্ভ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়, মুসলমানদের প্রথম গৃহযুদ্ধ, যা উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধের অবসান ঘটলেও, প্রথমবারের মত নিজেদের মাঝে ঐক্য বিনিষ্ট হয়। 

মদীনা, কূফা ম্যাপ

যুদ্ধের পর ৬৫৭ খ্রি. আলী (রা), মদীনা থেকে ইরাকের কূফায়, ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী স্থানন্তর করেন। কুফায় রাজধানী স্থানান্তরের পর, ইসলামী রাষ্ট্রের ঐক্য ও অখন্ডতা রক্ষার্থে বিদ্রোহী শাসনকর্তাদের তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের দাবিতে সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসক মুয়াবিয়া (রা.) এর বিরোধিতা করে।

ফলে মুয়াবিয়া (রা) এবং আলী (রা) এর মধ্যে দ্বন্দ দেখা দেয়। এবং এই দ্বন্দের প্রেক্ষাপটে উভয় পক্ষের মধ্যে ৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক সিফিফনের যুদ্ধ। অমিমাংসিত এই যুদ্ধের পর উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র দুইটি খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে মুয়াবিয়া (রা) সিরিয়া ও মিসরের সার্বভৈাম ক্ষমতার অধিকারি হন। অন্যদকে ইরাক, মক্কা , মদিনা সহ অবশিষ্টা অংশে আলী (রা) এর খিলাফত অব্যাহত থাকে। প্রসঙ্গত মুয়াবিয়া (রা) স্বাধিন শাসক হলেও, আলী (রা) এর ইন্তেকাল পূর্ব পর‌্যন্ত নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন নি।

পড়ুন:উমাইয়া খলিফাদের বংশ তালিকা

অতঃপর ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি এক খারিজি সমর্থকের বিষাক্ত চুরির আঘাতে হযরত আলী (রা) শাহাদাত বরণ করেন। তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে রাশেদিন খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে। আলী (রা) এর শাহাদাতের পর তার পুত্র ইমাম হাসান (রা) ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হিসেবে মনোনিত হলেও বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে তিনি মুয়াবিয়া (রা) এর নিকট খেলাফতের দায়িত্ব হস্তানন্তর করেন। এরপর ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে রাশেদিন খিলাফতের পরিসমাপ্তির পর মুয়াবিয়া (রা) এর নেতৃত্বে সিরিয়ার দামেস্ক কেন্দ্রীক উমাইয়া খেলাফতের অগ্রযাত্রার সূত্রপাত হয়।

✏️তথ্যের উৎস: 📘ইসলামের ইতিহাস- সৈয়দ মাহমদুল হাসান 📘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি- সৈয়দ মাহমুদুল হাছান 📘ইসলামের ইতহিাস- মুহাম্মদ মিজানুর রশিদ 📘আরব জাতীর ইতিহাস- শেখ লুতফর রহমান 📘দ্যা লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি- ফিরাস আল খতিব 📘খিলাফতে রাশেদা- মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহিম 📘খোলাফায়ে রাশেদীন : জীবন ও কর্ম - মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন 📘খুলাফায়ে রাশেদীন - ড. আলী ‍মুহাম্মদ সাল্লবী 📘 উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবসাইট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ