ইসলামের তৃতীয় খিলাফত ও স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত আব্বাসীয় খিলাফত ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আবুল আব্বাস আস সাফফা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটলেও ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত মিশরের মামলুক সুলতানদের অধিনে এই খিলাফতের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। প্রায় সাড়ে শাতশ বছর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস এবং আব্বাসীয় খলিফাদের বংশ তালিকা ও শাসনকাল একটি ভিডিওর মধ্যে উপস্থাপন করা খুব কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়।
তাই আব্বাসীয় খিলাফতের এই সাড়ে শাতশ বছরের ইতিহাসকে কয়েকটি যুগে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি যুগ নিয়ে একেকটি ভিডিও তৈরি করে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। যুগ গুলো হলো যথাক্রমে- গৌরবের যুগ, তুর্কি, বুয়াহিদ, সেলজুক, জেঙ্গী ও আয়ুবিদ যুগ, মোঙ্গল আক্রমণ ও পতনের যুগ, মিশরের মামলুক সালতানাত কর্তৃক খিলাফত পুনরুদ্ধারের যুগ এবং সর্বশেষ উসমানীয় তুর্কি সালতানাত কর্তৃক আব্বাসীয় খেলাফতের চূড়ান্ত পতনের যুগ।
আরও পড়ুন: আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস (৭৫০-৮৪২খ্রি.) ও বংশ তালিকা
মূলত ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবুল আব্বাস আসাফা কর্তৃক আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ৮৩৩ খ্রি. খলিফা আল মামুনের রাজত্বকাল পর্যন্ত সময়কে গৌরবের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। গৌরবের যুগের পতনের পর আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকারচ্ছন্ন অধ্যায় তুর্কি যুগের সূচনা ঘটে। ৮৩৩ থেকে ৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছরের শাসনকালকে আব্বাসীয় খিলাফতের তুর্কি যুগ হিসেবে বিবেচিত করা হয়।
![]() |
আব্বাসীয় খিলাফত |
৮৩৩ খি. খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা মু’তাসিম বিল্লাহ আব্বাসীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন অষ্টম আব্বাসীয় খলিফা। খলিফা মু’তাসিম নিজ সৈন্যবাহিনীর আরব ও পারসিক সৈন্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ, বুখারা, নিশাপুর, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার নওমুসলিম তুর্কি যুবক এনে একটি বিশাল তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন।
এরা ছিল রোমান প্রিটুরিয়ান এবং তুর্কি জেনিসারি বাহিনীর মত। এই দেহরক্ষী সেনাবাহিনী খলিফার আদেশ ব্যাতিত আর কারও আদেশ মানত না। প্রথমদিকে খলিফা মু’তাসিম এই তুর্কি বাহিনী নিয়ে সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ ও বিচ্ছৃঙ্খলা দমন করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তীতে এই বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা, লুন্ঠন ও অত্যাচারের কারণে তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সমৃদ্ধ নগরী বাগদাদের জনজীবন অতিষ্ট হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: রাশেদুন খিলাফতের ইতিহাস (৬৩২-৬৬১ খ্রি.) ও খলিফাদের বংশ তালিকা
তাই খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ বাধ্য হয়ে ৮৩৬ খ্রি. আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী জ্ঞান-বিজ্ঞানের নগরী বাগদাদ থেকে ৬০ মাইল উত্তরে সামারা নামক শহরে স্থানন্তর করেন। এই নগর দীর্ঘ ৫৬ বছর অর্ধাৎ ৮৩৬ থেকে ৮৯২ খ্রি. পর্যন্ত আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বিবেচিত ছিল।
৮৪২ খ্রি. আব্বাসীয় খিলাফতের শেষ ও শ্রেষ্ঠ খলিফা মৃ’তাসিমের মৃত্যুর পর তার জৈষ্ঠ্যপুত্র আল ওয়াসিক বিল্লাহ সামারায় আব্বাসীয় খিলাফতের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৮৪৭ খ্রি. খলিফা ওয়াসিকের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা আল মুতাওয়াক্কিল সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার শাসনকালে তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীর ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
![]() |
মক্কা ও মদীনা |
৮৬১ খ্রি. আল মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসতানসির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। খলিফা মুসতানসিরের খেলাফতকালে তুর্কি বাহিনীর ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই বৃ্দ্ধি পাই যে, পরবর্তী খলিফারা তাদের হাতের ক্রিড়ানকে পরিণত হয়ে পড়ে। এমনকি ৯৪৪ খ্রি. পর্যন্ত ১১ জন আব্বাসীয় খলিফার ক্ষমতা লাভ ও হারানো তুর্কি বাহীনির ইচ্ছের উপর নির্ভর করত। যেমনটা বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তানের মত দেশ গুলোতে সরকারের উত্থান ও পতনে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আমরা দেখতে পাই।
তাছাড়া আব্বাসীয় খলিফাদের দৃর্বলতার সুযোগে এ যুগে আব্বাসীয় খিলাফতের অধিকাংশ প্রদেশ স্বাধীন হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র মক্কা-মদিনা এবং বাগদাদ সহ অল্প কিছু অঞ্চল আব্বাসীয় খিলাফতের অধিনস্ত ছিল। তুর্কি যুগের খলিফাদের রাজ্য বিজয়ের জন্য নই, বরং নিজেদের সিংহাসন ধরে রাখতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। যাই হোক, ৮৬২ খ্রি. খলিফা মুসতানসিরের মৃত্যুর পর তার পিতৃব্য মুহাম্মদের পুত্র মুস্তাইন বিল্লাহ খিলাফত লাভ করেন। ৮৬৬ খ্রি. খলিফা মুস্তাইনের মৃত্যুর পর মুসতানসিরের ভ্রাতা আল মু’তাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এসময় তিনি দুর্ধর্ষ তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীর বেতন প্রদানে অসমর্থ হলে তুর্কিরা ৮৬৯ খ্রি, খলিফা আল মু;তাজকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং পিতৃব্য ওয়াসিক বিল্লাহর পুত্র মু’হতাদী বিল্লাহকে ক্রিড়ানক খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করে। ৮৭০ খ্রি. খলিফা মুহতাদীর মৃত্যুর পর তার পিতৃব্য মুতাওয়াক্কিলের পুত্র মুতামিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ৮৭০ থেকে ৮৯২ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর তুর্কি বাহিনীর ক্রিড়ানক হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। তার খিলাফতকালে ইসলামী বিশ্বে ৩ টি খিলাফতের উত্থান ঘটে।
আরও পড়ুন: উমাইয়া খলিফাদের ইতিহাস (৬৬১-৭৫০খ্রি. ও খলিফাদের বংশ তালিকা
আব্বাসীয় খিলাফত ব্যাতিত অপর দুইটি খিলাফত হলো উত্তর আফ্রিকা ও মিশরের ফাতেমী এবং স্পেনের উমাইয়া খিলাফত। ৮৯২ খ্রি. খলিফা মু’তামিদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মু’তাজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৮৯২ খ্রি. খলিফা মু’তাজিদ সামারা থেকে বাগদাদে পুনরায় আব্বাসীয় খিলাফতের স্থানন্তর করেন। ৯০২ খ্রি. খলিফা মুতাজিদের মৃত্যুর পর তার জৈষ্ঠপুত্র মুকতাফি খিলাফত লাভ করেন।
তার শাসনকালে উগ্র শিয়া পন্থি কারামতিদের উত্থান হয়। কারামতি সম্প্রদায় সেই সময় কাবায় আক্রমণ করে হাজার হাজার হাজীদের হত্যা করে এবং পবিত্র কালো পাথর চুরি করে তাদের ঘাটি বাহরাইনে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে আব্বাসীয়রা পবিত্র কালো পাথরটি তাদের থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
৯০৮ খ্রি.খলিফা মুকতাফির মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা মুকতাদির সিংহাসনে আরোহণ করেন। দীর্ঘকাল শাসনকার্য পরিচালনার পর তুর্কিদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করার কারণে তুর্কিরা ৯৩২ খ্রি. খলিফা মুকতাদিরকে সিংহাসচ্যুত ও হত্যা করে। খলিফা মুকতাদিরের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা কাহির বিল্লাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন কিন্তু ৯৩৪ খ্রি. তুর্কি বাহিনী তাকেও সিংহাসনচ্যুত ও হত্যা করে।
খলিফা আল কাহিরের মৃত্যুর পর তার জৈষ্ঠ্য পুত্র আল রাজী পরবর্তী খলিফা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার শাসন কালে খলিফার পাশাপাশি তুর্কি আমিরুল উমরার নামেও খুৎবা পাঠ এবং মুদ্রা অঙ্কিত করা হতো। ৯৪৪ খ্রি. খলিফা আল রাজীর মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা আল মুত্তাকী খিলাফত লাভ করেন। ৯৪৪ খ্রি. খলিফা আল মুত্তাকীর মৃত্যুর পর তার পিতৃব্য মুকতাদিরের পুত্র মুসতাকফি বিল্লাহ খিলাফত লাভ করেন।
![]() |
বুয়াহিদ রাজবংশ |
তার শাসনকাল ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় ও অরাজকতাপূর্ণকাল। এসময় তিনি তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী ও আমির-উমরাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে খিলাফতের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য পথ খুজছিলেন। অতপর খলিফা মুসতাকফি বিল্লাহ তুর্কি আমির-উমরা ও সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, তাদের থেকে চিরতরে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালীন পারস্যের ফারস প্রদেশের শিয়া পন্থি বুয়াহিদ রাজবংশের আমির মুইযউদ্দৌল্লাহকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান।
বুয়াহিদ আমির মুইযউদ্দৌলাহ ৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্য নিয়ে বাগদাদে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীকে পরাজিত করে , তুর্কি বাহিনী ও আমির উমরার শাসনের অবসান ঘটান এবং বুয়াহিদ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, শিয়াপন্থি বুয়াহিদ রাজবংশকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে আব্বাসীয় খলিফা মুসতাকফি বিল্লাহ মূলত খাল কেটে কুমির এনছিল।
0 মন্তব্যসমূহ