মুসলমানদের কিভাবে সর্বপ্রথম সিন্ধু রাজ্য বিজয় করে?

                                                                              


অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বৃহত্তর রোমান বায়জান্টাইন সাম্রাজ্য মুসলমানদের কাছে ধরাসয়ী হয়ে কনস্টান্টিনোপলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে পারস্যের শক্তিশালী সাসানীদ সাম্রাজ্যও ইতিপূর্বে ইসলামী খেলাফতভুক্ত হয়ে পড়ে। সমগ্র চীনে তখন বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যে চলছিল গৃহযুদ্ধের দামামা। ইউরোপে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছিলা এংগলো-স্যাক্সন, ড্যানিশ ও নরম্যান জাতীগুলো। ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগ খ্যাত গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উপমহাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে গুলোর মধ্যেও তখন যুদ্ধ-বিগ্রহ চলমান ছিল। এমনকি আমাদের বাংলায় চলছিল তখন মাৎসন্যায় তথা অরাজকতার যুগ।

আরও পড়ুন: ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস (সিন্ধু সভ্যতা থেকে মুসলিম বিজয়)

মানবসভ্যতার এই দুঃসময়ে সমগ্র বিশ্বের দিকেবেদিকে বিজয়ের পতকা উত্তোলন করে ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছিল শত-সহস্র মুসলিম বীর সেনানীরা। উমাইয়া খেলাফতের অধীনে থেকে এই বিজয়ীরা সূদুর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে, মধ্য এশিয়া থেকে চীনে এবং পারস্য থেকে ভারতবর্ষে ইসলামের বিজয়ের কেতন উড়িয়েছিল। এমনি একজন বীর ছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। তার নেতৃত্বে মুসলমানরা সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় করে। 

৬৩২ খ্রি. মহানবী (স) এর ওফাতের পর মদীনা কেন্দ্রীক ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতীর প্রতিনিধি বা অবিভাবক নিযুক্ত হন রাশেদিন খিলাফতের খলিফারা। ৬৬১ খ্রি. শেষ রাশেদিন খলিফা আলী (রা) এর মৃত্যুর পর ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হয় উমাইয়া রাজবংশের উপর। দামেস্ক কেন্দ্রিক উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ইসলামী সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নব-যুগের সূচনা হয়। এই খিলাফতের খলিফা আল ওয়ালিদের শাসনকালে অর্থাৎ ৭০৫ থেকে ৭১৫ খ্রি. মধ্যে

                                                          


মুসলমানরা সমগ্র আরব, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মধ্য এশিয়া, খোরাসান, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, ইউরোপের স্পেন ও পুর্তুগাল এবং ভারতবর্ষের সিন্ধু ও মুলতানে ইসলামী সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। এর মধ্যে সিন্ধু ও মুলতান বিজয় ইসলামের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অভিযান এবং ইসলামের প্রসারের জন্য পথ খুলে দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হতো উপমহাদেশের 'বাবুল ইসলাম' বা ইসলামের প্রবেশপথ। মুসলমানদের সিন্ধু অভিযানের বেশ কিছু যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল।

সুদুর প্রাচীন কাল থেকে আরবরা আরবসাগর হয়ে ভারতবর্ষ এবং সিংহল তথা শ্রিলঙ্খায় ব্যাবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত। ৬২২ খ্রি, মহানবীর (স) মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে। তখন ব্যবাসায়ীদের পাশাপাশি মুসলিম ধর্মপ্রচারকরাও উক্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য গমন করত। একসময় তারা সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের কেরালা রাজ্যের মালাবারে এবং সিংহলে ইসলাম প্রচার ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম বসতি গড়ে তুলে।

এরপর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) এর খেলাফতকালে মুসলমানদের পারস্য অভিযানকালে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা ভারতবর্ষের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এমনকি এ সময় সীমান্তবর্তী লোকদের বিদ্রোহাত্মাক কর্মকান্ডের জন্য ওমান থেকে সর্বপ্রথম ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণ করে হয়েছিল, কিন্ত তা ফলপ্রসু হয় নি।

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা) এর শাসনামলে ৬৪৪ খ্রি. মুসলিম সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন বারীর নেতৃত্বে মুসলমানরা পারস্যের কিরমান বিজয় করেন। এরপর তিনি সিস্তানের হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। অত:পর বিজয়ী সেনাপতি আব্দুল্লাহ সিন্ধু ও মেকরানের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে মেকরান অঞ্চল বিজয় করেন।

মেকরান ছিল বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের পশ্চিমের একটি অঞ্চল। মুসলমানরা এই অঞ্চল বিজয় করার ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা হিন্দু রাজা দাহিরের সিন্ধু রাজ্যের অতি সন্নিকটে চলে আসে। প্রসঙ্ত এই সিন্ধুতে প্রাচীন কালে ভারতবর্ষের প্রথম নগর সভ্যতা গড়ে ওঠে এবং এটি বর্তমানে পাকিস্তানের সাতটি প্রদেশের অন্যতম একটি প্রদেশ।

আরও পড়ুন: মুহাম্মদ বিন কাসি, কে ছিলেন?

যাই হোক মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা সিন্ধু রাজ্যের সীমান্তে এসে পড়াই উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। বিশেষে করে হিন্দু রাজাদের শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব এবং সামরিক হস্তেক্ষেপ মুলমানদের সিন্ধু অভিযানে উৎসাহিত করে। সেই সময় উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের পূর্বঞ্চলীয় অর্থাৎ ইরাকের প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তার শাসনাধীন কিছু আরব মুসলিম বিদ্রোহী পালিয়ে গিয়ে সিন্ধুর রাজা দাহিরের রাজ্যে আশ্রয় নেয়।

রাজা দাহির

                                                             

হাজ্জাজ রাজা দাহিরকে বিদ্রোহীদের ফিরিয়ে দিতে বললেও রাজা দাহির তা প্রত্যাখ্যান করে, এতে হাজ্জাজের সাথে রাজা দাহিরের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাছাড়া ব্রাক্ষ্মণ সিন্দুরাজ দাহির ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী ও রক্তপিপাসু শাসক। তিনি তার রাজ্যের নিন্মবর্ণের হিন্দু, জাট, মেড সম্প্রদায় এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের ওপর অকাথ্য জুলুম ও নির্যাতন চালাত। এই মজলুম ও নির্যাতিত সিন্ধু রাজ্যের প্রজারা দাহিরের জুলুম ও অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট আবেদন জানায়। তাই তিনি সিন্ধু রাজ্যে অভিযান পরিচালনার জন্য মনস্থির করেন।

সিন্ধু বিজয়ের প্রত্যেক্ষ্য কারণ ছিল সিংহল থেকে ইরাক হয়ে দামেস্ক আসার পথে সিন্ধুর জলদস্যু কর্তৃক আটটি মুসলিম জাহাজ লুন্ঠন। সিংহলের অনুরধাপূর রাজ্যের রাজা মানাভান্নার সাথে খলিফা ওয়ালিদ এবং হাজ্জাজের ভালো সম্পর্ক ছিল। একদা সিংহলে অবস্থিত কিছু মুসলিম ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকের মৃত্যু হলে, তাদের পরিবারবর্গকে একটি জাহাজে করে এবং সাথে উপহার-উপঢৈাকন সহ আরও ৭ টি জাহজ সহ, মোট আটটি জাহাজ সিংহলরাজ মানাভান্না, খলিফা ওয়ালিদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।

কিছু কিছু ঐতিহাসকিদের মতে, সিংহলরাজ নিজে ইসলাম গ্রহণ করে খলিফার জন্য উপহার প্রেরণ করেছিলেন। যাই হোক এই আটটি জাহাজ সিংহল থেকে আরব সাগর হয়ে ইরাক ও দামেস্কের দিকে যাত্রা করলে, খারাাপ আবহাওয়া জনিত কারণে সিন্ধুর দেবল বন্দরে মুসলিম নাবিকরা জাহাজের নুঙ্গর করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেখানে সিন্ধুর জলদস্যুরা জাহাজের মালামাল লুণ্ঠন করে এবং সিংহলে পরলোকগত মুসলমানদের স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের বন্দি করে।

এই দুর্ঘটনার কথা জানার পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরের নিকট জলদস্যুদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান এবং ক্ষতিপূরণের দাবী জানান। কিন্তু রাজা দাহির নাটকীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার জানায় এবং জলদস্যুদের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই ও তাদের শাস্তি দানে অক্ষম বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

অতপর এতে ক্রুদ্ধ হয়ে দাহিরকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য হাজ্জাজ খলিফা ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে প্রথমে ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ সহ অনেক মুসলিম সৈন্য রাজা দাহিরের বাহিনীর হাতে যুদ্ধে শহীদ হন। এরপর ওমানের শাসক বোদাইলের নেতৃত্বে সিন্ধুতে দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি ও তার সৈন্যবাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে আবারও পরাজিত হয়। হাজ্জাজ এই দু:সংবাদ পেয়ে খুবই ব্যথিত হন।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দু’বার ব্যর্থ হয়েও হাল ছেড়ে দেন নি। সিন্ধু রাজা দাহিরের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণেরউদ্দেশ্যে তিনি তার স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে তৃতীয় অভিযানের সেনাপতি করে সিন্ধু প্রেরণ করেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। এরপর তিনি ১২ হাজারের একটি সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইরাক থেকে ওমান হয়ে মাকরান সীমান্ত দিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করেন। এই বাহিনীর মধ্যে ৬ হাজার ছিল অশ্বারোহী, ৩ হাজার পদাতিক এবং বাকি ৩ হাজার সৈন্য রসদবাহী উটের সাথে ছিল।

  আরও পড়ুন: ভারতবর্ষের ইসলাম আগমনের ইতিহাস                                                       

এই সৈন্যবাহিনীকে মাকরানের শাসক বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন। অন্যদিকে রাজা দাহিরের ক্ষুদ্ধ নিন্ম বর্ণের হিন্দু, জাট, মেড এবং বৈাদ্ধ সম্প্রদায়ের সৈন্যরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীতে যোগদান করে। ফলে ‍মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাছাড়া মুহাম্মদ বিন কাসিমের সৈন্যবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে জলপথে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আরও কিছু অতিরিক্ত সৈন্য সহ বুলিস্তা নামের একটি আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রও প্রেরণ করেন।

বলিস্তা বা ব্যালেস্টিক ছিল এক ধরণের ক্ষেপাণাস্ত্র। এটি দিয়ে ভারি-পাথর দূরে নিক্ষেপ করে শত্রুকে আঘাত করা যেত। এদিকে মুসলামানদের সিন্ধু অভিযানের খবর রাজা দাহির আগেই পেয়ে যান। এবং তার প্রায় ৫০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য তখন দেবল দুর্গ পাহারারত ছিল। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মাকরান থেকে রাজা দাহিরের সিন্ধু রাজ্যের প্রবেশদ্বার দেবলে পৌছান।

দেবল যেমন একটি শক্তিশালী দুর্গ ছিল, তেমনি সমুদ্র বন্দরের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। এই দেবলের বন্দরে মুসলমানদের আটটি জাহাজ লুন্ঠন করেছিল সিন্ধুর জলদস্যুরা! তাই প্রথমে মুহাম্মদ বিন কাসিম মুসলিম সেনানীদের দেবল দুর্গ অবরোধের নির্দেশ দেন। দেবলের প্রধান মন্দিরের চূড়ায় একটি লাল নিশানা উড়ানো ছিল। সচুতুর মুসলিম সেনানায়ক মুহাম্মদ বিন কাসিম জানতেন, হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল, মন্দিরের চূড়ায় যতক্ষণ নিশানা উড়বে, ততক্ষণ বাইরে কোন শত্রু দেবল দখল করতে পারেবা না। তাই তিনি প্রথমে বলিস্তা দিয়ে পাথর ছুড়ে নিশানাটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। নিশানাটি নামিয়ে পেলা হলে হিন্দুদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।

এরপর মুসলিম সেনারা প্রাচীর ভেঙ্গে দেবল দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করে। অতপর দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হলো। অসীম সাহসের সাথে হিন্দু সৈন্যরা যুদ্ধ করলেও মুহাম্মদ বিন কাসিমের রণকৌশলের কাছে তারা পরাজিত হয়। অবশেষে দেবল দুর্গ ও বন্দরে উড়ল ইসলামের বিজয়ী নিশানা। সেই বন্দিদের মুক্ত করা হলো। দেবল বিজয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম চার হাজার সৈন্যবাহিনীর একটি সেনানিবাস দেবলে স্থাপন করেন। এরপর মুসলিম বাহিনী সিন্ধু নদের তীর ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একপ্রকার বিনা বাধায় নীরুন, সিওয়ান ও সিসাম প্রভৃতি শহর একের পর এক দখল করে নিলেন।

মুসলমানদের বিভিন্ন শহর জয়ের সাথে সাথে রাজা দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ট সিন্ধুবাসী ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। ফলে মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে থাকে। অতপর মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের দাপটে ধুলা উড়িয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন উত্তর থেকে পশ্চিমের রাওয়ার দুর্গের দিকে। কিন্তু রাওয়ারে পৌঁছানোর পূর্বেই রাজা দাহির তার ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অগ্রযাত্রা রোধ করতে আসেন।

আরও পড়ুন: পানিপথের যুদ্ধ - ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের উত্থান

এসময় তার বাহিনীতে রাজা দাহিরের চেয়ে সৈন্যসংখ্যা অনেক কম ছিল। সিন্ধু নদী অতিক্রম করে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বাহিনী নিয়ে রাওয়ার দুর্গ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সৈন্য সমাবেশ করেন। সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েকদিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে রাজা দাহির যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়। তার মৃত্যুতে হিন্দু সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে পালিয়ে যায়।

রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রানী বাঈ এবং পুত্র জয়সিংহ প্রায় ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে অবস্থান নেয় রাওয়ার দুর্গের ভেতরে। কিন্তু মুসলমানদের আক্রমণের মুখে রাওয়ার দুর্গের পতন ঘটে। অবশেষে ৭১২ সালের ১২ জুন মুসলামনরা রাওয়ার দুর্গ চূড়ান্তভাবে বিজয় করতে সক্ষম হয়। রাহওয়ার দুর্গ বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু স্থানীয় ব্রাক্ষ্মনরা সহজে বশ্যতা স্বীকার করায় মুসলিমরা সহজে এই শহর দখল করতে সক্ষম হয়। ব্রাক্ষ্মনাবাদ বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী সিন্ধু রাজ্যের রাজধানী আলোর দুর্গও অধিকার করে নেয়। এরপর বিজয়ীর বেশে মুসলিম বাহিনী যাত্রা করে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী শহর মুলতানের দিকে। মুলতান দখল করতে মুসলিম বাহিনীর বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। হিন্দু বাহিনী মুলতান রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।

                                                        


অবশেষে ৭১৩ খ্রি. দীর্ঘ দুইমাস অবরোধের পর মুসলিম বাহিনী মুলতান বিজয় করতে সক্ষম হয়। এই বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং রাজা দাহিরের সমগ্র রাজ্য মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। একই সাথে ভারত ভূমিতে ইসলামের বিজয়ী পতাকা উত্তোলিত হয়। যদিও মুলতান বিজয়ের পর তিনি তার সুযোগ্য সেনাপতি আবু হাকিমকে কনৌজ অভিযানের নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু অভিযান আরম্ভ করার পূর্বেই নব নির্বাচিত উমাইয়া খলিফা সুলাইমানের নির্দেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজধানী দামেস্কে প্রত্যাবর্তন করেন। এবং এখানেই ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২১ বছর বয়সে এই মহান বীরের জীবনবসান হয়।

মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই বিজয়ের ফলে নিন্মশ্রেণীর হিন্দু, জাট, মেড ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় অভিশপ্ত জাতিবেধ প্রথা ও সামাজিক অবিচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা দলে দলে সাম্য-মৈত্রী ও শান্তির ধর্ম ইসলামে দিক্ষীত করে। এ বিজয় আরব সাম্রাজ্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হয় উভয় দেশ।

আরও পড়ুন: মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের ইতিহাস

তাছাড়া সিন্ধু বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষের দর্শন, সাহিত্য, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জৌতির্বিদ্যা, সংগীত ও চিত্রশিল্প প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখার সাথে মুসলমানরা পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় সভ্যতা ও ইসলামী সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগের ফলে উভয়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্র সমৃদ্ধি হয়। এ বিজয়ের ফলে অসংখ্য আউলিয়া,দরবশে ও ধর্মপ্রচারকরা ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- হযরত নিজামুদ্দুন, খাজা মুইনুদ্দিন চিশতী, শাহাজালাল প্রমুখ।

তাছাড়া সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবীয় ও ভারতীয় অর্থাৎ সেমিটিক ও আর্য জাতির সংমিশ্রণে ভারতবর্ষে একটি নতুন জাতীর উদ্ভব হয়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় সুলতান মাহমুদকে বারবার ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণ করতে অনুপ্রাণীত করেছিল। সুলতান মাহমুদের পর মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লী ও আগ্রা সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিজয় করে ভারতবের্ষ দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এই বিজয়কে ভিত্তি করে।

              ভিডিও দেখুন:

                             


তথ্যের উৎস :

📘 ভারতবর্ষের ইতিহাস -  ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান

📘 ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস – এ.কে.এম আবদুল আলীম

📘 মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায় – শাহাদাত হোসেন খান

📘 ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস – ড. মুহাম্মদ ইনামুল হক

📘 ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ গোলাম রসূল

📘 ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন – আব্দুল করিম

📘 মুঘল ভারতের ইতিহাস – মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান

📘 মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস – অনিরুদ্ধ রায়

📘 উইকিপিড়িয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ব্লগ ও অনলাইস ওয়েব সাইট


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ