সেলজুক সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস । সেলজুকদের উত্থান ও পতন।

                                                            


একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। মিশরের পথভ্রষ্ট শিয়া ফাতেমী খলিফাদের চক্রান্ত, বায়জান্টাইন খ্রিস্টানদের আক্রমণ কিংবা নিজেদের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দে লড়াইয়ের ফলে পরাক্রমশালী বাগদাদের সুন্নি আব্বাসীয় খেলাফত প্রায় পতনম্মুখ। তখন শতাদ্বাবিভক্ত মুসলিম জাতী সংকটময় জীবন অতিবাহিত করছিল। ইসলামকে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য বাতিল শক্তি উঠেপড়ে লেগেছিল। মুসলিম জাতীর এই সংকটময় দুরঅবস্থায় ইতিহাসের দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে সেলজুক তুর্কি মুসলিমদের।

 

সেলজুকরা একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বীরত্বের সাথে মুসলিম জাতীর নেতৃত্বে দিয়েছিল প্রায় দেড়শত বছর ধরে। কিন্তু মিশরের শিয়া মতলম্বী ফাতেমী খেলাফতের ষড়যন্ত্র, বাতেনী শিয়া গুপ্তঘাতক দলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, খ্রিস্টান ক্রুসেড যুদ্ধাদের ধর্মান্ধ অভিযান সর্বপুরি ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মাঝে দ্বন্দ ও গৃহযুদ্ধের ফলে এক সময় এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।     

 আরও পড়ুন: সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তুঘ্রিল বেগ

সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান ‍কিভাবে ঘটেছিল? এই সাম্রাজ্যের শাসক কারা ছিলেন? এবং কিভাবে এই সাম্রাজ্যের পতন হয়? সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।                       

                                                    

সেলজুক সাম্রাজ্য

 মূলত সেলজুক সাম্রাজ্যের নামকরণ হয় অগুজ দলপতি সেলজুক বেগের নাম থেকে। সেলজুক বেগের পৌত্র তুঘ্রীল বেগ ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইস্পাহানকে কেন্দ্র করে সেলজুক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তিনি গজনী ও বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে নিশাপুর, মার্ভ, তাবারিস্তান, হামাদান, রায় প্রভৃত্তি শহর বিজয় করে সেলজুক সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করেন। তুঘ্রীল বেগ শিয়া বুইয়া আমির, ফাতেমি খিলাফত এবং বায়জান্টাইনদের ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ থেকে বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফতকে রক্ষা করেন এবং খলিফার মর‌্যদা ও সম্মান বৃদ্ধি করেন।

 

এই কারণে আব্বাসীয় খলিফা আল কাইম বিল্লাহ তুঘ্রীল বেগকে প্রাচ্য ও প্রাতিচ্যের সুলতান উপাধিতে ভূষিতে করেন। তখন থেকে সেলজুক শাসকরা সুলতান উপাধী ধারন করে আসছেন। ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান তুঘ্রীল বেগ বায়জান্টাইনদের পরাজিত করে ডোসিয়া ও ফিজিয়া অঞ্চল বিজয় করেন। তার রাজত্বকালে বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী আল বিরুনী ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১০৬৩ সুলতান তুঘ্রীল বেগ নি:সন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার ভ্রাতুষ্পুত্র সেলজুক সিংহ মোহাম্মদ আল্প আরসলান সেলজুক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজত্বেকালে সর্বাপেক্ষা উল্ল্যেখযোগ্য ঘটনা ছিল বায়জান্টাইনদের সাথে সংঘর্ষ।     আরও পড়ুন; মানজিকার্টের যুদ্ধ


সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি বায়জান্টাইনদের থেকে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া বিজয় করেন। এরপর ১০৭১ খ্রিস্টব্দ সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক মানজিকার্টের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে মাত্র ৪০ হাজারের মুসলিম বাহিনী দুই লক্ষ্যের অধিক বায়জান্টাইন খ্রিস্টান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছিল। এই বিজয়ে ফলে সমগ্র এশিয়া মাইনর তথা আনাতোলিয়া মুসলমানরা বিজয় করতে সক্ষম হয়। এই এশিয়া মাইনরে বর্তমান তুরস্ক রাষ্ট্র স্বগৌরবে দাড়িয়ে আছে।

                                                           

মানজিকার্টের যুদ্ধ

 সুলতান আল্প আরসালানের অন্যতম আরও একটি কৃতিত্ব হলো, তার আতা বে বিখ্যাত মনীষী হাসানকে নিজামুল মুলক উপাধি দিয়ে সেলজুক সাম্রাজ্যের ‍উজির নিযুক্ত করা। নিজামুল মুলক একদিকে কঠোর অধ্যাবসায় এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখার মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতাকে উৎকর্ষতা প্রধান করেন। ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে এক বিদ্রোহীর হাতে সুলতান আল্প আরসালান নিহত হলে,তার পুত্র মালিক শাহ সাম্রাজ্যের নতুন ‍সুলতান হন।

 আরও পড়ুন: সেলজুক সিংহ সুলতান আল্প আরসালানের ইতিহাস

সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে সেলজুক সাম্রাজ্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তিনি শুধু মাত্র সেলজুক সুলতানদের মধ্যেই সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন না, বরং তৎকালীন বিশ্বের নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিল। তার রাজত্বকালে সেলজুক সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।     

 

অর্ধ পৃথিবীর শাসক সুলতান মালিক শাহ সাম্রাজ্য বিস্তারে পাশাপাশি শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানেও সমানভাবে অবদান রেখে গেছেন। তিনি নিজামুল মুলুককে পিতার মতই সাম্রাজ্যের উজির পদে পুনর্বহাল রাখেন। নিজামুল মুলক ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে সিয়াসত নামা গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন। এই গ্রন্থে সেলজুক সাম্রাজ্যের সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হত। তিনি ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করে শিয়া ভ্রান্ত মতবাদ থেকে সুন্নি মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করেন।

 

সুলতান মালিক শাহের শাসনকালে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও চিন্তাবীদ ইমাম গাজ্জালী নিজামুল মুলুকের পৃষ্টপোষকতায় শিয়া মতবাদের সমালোচনা করে সুন্নী ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্টা করেন। বিখ্যাত কবি, গণিতবিদ ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম তার শাসন আমলে পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল ক্যালেন্ডার “জালালী দিনপন্জিকা’ আবিষ্কার করেন।

 

সুলতান মালিক শাহের রাজত্বের শেষের দিকে উগ্র ইসমাইলি শিয়া পন্থী হাসান সাব্বাহ’র উত্থান, সেলজুক সাম্রাজ্যের মারাত্বক বিপরর‌্যয় ডেকে আনে। তার বাতেনী মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে সে গঠন করে ইতিহাসের ভয়ঙ্খর ও নিকৃষ্ট গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়। তারা শিয়া মতবাদ প্রতিষ্টার লক্ষ্যে তাদের বিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা করত। ঠিক এই কারণে ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে হাসান সাব্বাহ’র এক ফিদাই মক্কা থেকে ফেরার পথে বাগদাদে নিজামুল মুলুককে চুরিকাঘাতে হত্যা করে।  

                                                                  

নিজামুল মুলক

 সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট সুউচ্চ ও দুর্ভেদ্য আলামুত পর্বতে হাসান সাব্বাহ ঘাটি স্থাপন করে। সুলতান মালিক শাহ ‍দুইবার অভিযান পরিচালনা করার পরও তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নি। নিজামুল মুলূকের মৃত্যুর কয়েক মাস পর একুশ বছর সগৌরবে রাজত্ব করে ‍সুলতান মালিক শাহও মৃত্যুবরণ করে।

 

উজির নিজামুল মুলুকের আকস্মিক মৃত্যুতে সেলজুক সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বে আঘাত হানে।‍ আর সুলতান মালিক শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেলজুক সাম্রাজ্যের শ্রেষ্টত্ব ও ঐক্য বিলুপ্ত হয়। সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে তার উত্তরাধিকারীরা নিজেদের মাঝে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ে। মালিক শাহের মৃত্যুর পর তার তৃতীয় স্ত্রী তুরখান খাতুন বাগদাদের খলিফার সাহায্যে শিশু পুত্র মাহমুদকে সেলজুক সিংহাসনে অধিষ্টিত করান। মাহমুদ ১০৯২ থেকে ১০৯৪ খ্রি. পর‌্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।  

 আরও পড়ুন: নিজামুল মুলক আত তুসী সম্পর্কে জানোন

অপ্রাপ্ত বয়স্ক সুলতান মাহমুদের অবিভাবক হিসেবে তুরখান খাতুন এবং উজির তাজুল মুলুক সাম্রাজ্য পরিচালনা করত। এই সময় সেলজুক সাম্রাজ্য জুড়ে বিচ্ছৃঙ্খলা, বিদ্রোহ এবং অরাজকতা সৃষ্ট হয়। সাম্রাজ্যের এই খারাপ পরিস্থিতিতে তার জৈষ্ঠ সৎভাই বারকিয়ারুক তাকে পদচ্যুত করে সিংহসানে আরোহণ করেন। তিনি ১০৯৪ থেকে ১১০৫ খ্রিস্টাব্দে পর‌্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। বারকিয়ারুকের রাজত্বকালে হাসান সাব্বা’হর বাতেনী সম্প্রদায়ের উৎপাত আরও বৃদ্ধি পাই। তাদের দমানোর মত শক্তি সুলতানের ছিল না।

 

তাছাড়া তার শাসনকালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের উত্থান। এই সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল শিয়া ফাতেমি খিলাফত এবং সেলজুক সাম্রাজ্য। নিজেদের মাঝে দ্বন্দ ও গৃহযুদ্ধের ফলে ক্রুসেডাররা ‍১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া ক্রুসেডের যুদ্ধে বিজয়ি হয়ে জেরুজালেম সহ বহু মুসলিম শাসিত অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়। সুলতান বারকিয়ারুক ক্রুসেডারদের বেশকয়েকটি আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করতে পারলেও, তাদের আক্রমণে সেলজুক সাম্রাজ্যে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

১১০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বারকিয়ারুকের মৃত্যুর পর তার অপর সৎ ভাই মোহাম্মদ তপার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজত্বকালও ছিল অরাজকতাপূর্ণ। সুলতান মুহাম্মদ তপার ১১১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে, কিছুদিনের জন্য তপারের পুত্র দ্বিতীয় মাহমুদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর সুলতান তপারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আহমেদ সেন্জার সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান আহমেদ সেন্জারকে বলা হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষ শ্রেষ্ঠ শাসক।         

 

তিনি রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার করেন। তিনি বাতেনী গুপ্তঘাতকদের নেতা হাসান সাব্বাহ’র বিরোদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে, তাকে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য করেন। তাছাড়া তিনি ক্রুসেডারদের বিরোদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম বীর ইমাম উদ্দীন জঙ্গি এবং নুরুদ্দিন জঙ্গিকে সামরিক সাহায্য প্রদান করেন। ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দ সুলতান আহমেদ সেন্জার মৃত্যু বরণ করেন।

                                            

রুম সালতানাত

 বস্তুত আহমেদ সেনজারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন অনিবার‌্য হয়ে পড়ে। যদিও তার মৃত্যুর পর আরও ৯ সুলতান ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে পর‌্যন্ত শাসকার‌্য পরিচালনা করেছিল। কিন্তু তারা শুধু ইরান ও আজারবাইজানকেই নিয়ন্ত্রণ করেছিল। অবশেষে ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ দুর্বল সেলজুক শাসক তৃতীয় তুঘ্রিল বেগের মৃত্যুর পর পরাক্রমশালী সেলজুক সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আরও পড়ুন: রোমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহা

এরপর সেলজুক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পাঁচটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সালতানাতে পরিণত হয়। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো আনাতোলিয়ার রুমের সেলজুক সালতানাত। তৎকালীন সময়ে আনাতোলিয়া- কুনিয়া এবং রুম নামেও পরিচিত ছিল। তাই এই সালতানাতটি রুমের সালতানাত নামে পরিচিতি লাভ করে। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মানজিকার্টের যুদ্ধে বিজয়ের পর সুলতান আল্প আরসালান তার চাচাতো ভাই সুলাইমান বিন কুতলিমিশকে আনাতোলিয়ার শাসনভার প্রদান করেন। পরবর্তীতে সুলাইমানের পুত্র সুলতান কিলিজ আরসালান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনাতোলিয়া কেন্দ্রীক স্বাধীন রুমের সালতানাত।

 ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে রোমের সেলজুক সালতানাতানাতের পতনরে পর, আনাতোলিয়ার মাটিতে উসমান গাজীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় তিন মহাদেশ বিস্তৃত উসমানীয় সাম্রাজ্য । ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে উসমানী খেলাফতের পতনের পর একই মাটিতে জন্ম হয় আধুনিক তুরস্কের ।

                                                       

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ