বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি রাজা শশাঙ্কের উত্থান-পতনের ইতিহাস।

                                                                               

আনুমানিক ৫১৫ খ্রি. ভারতবর্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের যুগে যশোবর্ধন নামের দুর্ধর্ষ নৃপতি সমগ্র উত্তর ভারতে স্বিয় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যশোবর্ধন তার সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করে যেতে পারে নি। ৫৪৫ খ্রি. তার মৃত্যুর পর সৃষ্ট হওয়া অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজবংশ ভারতবর্ষে স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। 

আরও পড়ুন- প্রাচীন বাংলার ১৬ টি জনপদ সমূহ

এই রাজ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল- মৌখরী বংশ শাসিত কনৌজ রাজ্য, পুষ্যভূতিবংশ শাসিত থানেশ্বর রাজ্য, মালব রাজ্য, মগধের পরবর্তী গুপ্ত বংশ এবং বাংলার বঙ্গ ও গৌড় রাজ্য। বাংলার গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্টাতা হলেন রাজা শশাঙ্ক। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে তিনি একজন কীর্তীমান রাজা ছিলেন। তাকে বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়।                    

রাজা শশাঙ্ক গৌড় রাজ্যের সীমানা ও প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে কনৌজ ও থানেশ্বর রাজ্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাজশ্রী নামের থানেশ্বর রাজ্যের এক রাজকন্যাকে বন্দি করার কারণে সংঘটিত হওয়া এই যুদ্ধকে বাংলার ইতিহাসে চতুষ্শক্তির যুদ্ধ নামে অভিহিত করা যায়। মূলত এই যুদ্ধই রাজা শশাঙ্কের পতন ডেকে নিয়ে আসে।

                                                                    


রাজা শশাঙ্কের উত্থান-পতন এবং বাংলার ইতিহাসের চতুশ্ষক্তির যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।বাংলা তথা গৌড়ের প্রথম স্বাধীন নৃপতি শশাঙ্কের বংশ পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তিনি পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশের অধীনে মহাসামন্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত ৫৫০ খ্রি. গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলায় পরবর্তী গুপ্ত বংশ নামে একটি রাজবংশের উদ্ভব হয়। এই পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশ উত্তর বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ ও মগধে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। তখন এই অঞ্চল অর্থাৎ সমগ্র বাংল গৌড নামে পরিচিত ছিল। শশাঙ্ক এই রাজবংশের মহাসামন্ত অর্থাৎ প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন।  

আরও পড়ুন-বখতিয়ার খলজীর বাংলা ও বিহার বিজয়ের ইতিহাস

ষষ্ট শতাব্দীর শেষের দিকে উত্তর ভারতের কনৌজ রাজ্য, তিব্বতীয় রাজ্য এবং দক্ষিণ ভারতের চালুক্যরাজ কীর্তী বর্মণের আক্রমণের ফলে পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশের পতন ঘটে। একই সময় চালুক্যরাচ কীর্তীবর্মণের আক্রমণের ফলে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটে। পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশ এবং বঙ্গ রাজ্যের পতনের পর ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক গৌডের সিংহাসরে আরোহণ করে নিজেকে স্বাধীন ও সর্বভৌম রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি তার রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণাতে।              

গৌডের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর শশাঙ্ক রাজ্য বিস্তারের মনোনিবেশ করেন। শশাঙ্ক যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে দন্ডভুক্তি, উৎকল ও কঙ্গোদ রাজ্য দখল করে তার রাজ্যভুক্ত করেন। এরপর তিনি কামরুপ রাজা ভাস্করবর্মনকে পরাজিত করে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। ৬৬১ খ্রি উড়িষ্যার শৈলোদ্ভব রাজবংশও রাজা শশাঙ্কের আনুগত্য স্বীকার করে।                                             

মগধ

উত্তর, দক্ষিণ ও্র পূর্ব বাংলা এবং মগধকে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করার পর রাজা শশাঙ্ক এবার বাংলার পশ্চিম সীমান্তে রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতির ফলে কনৌজ রাজ্যের মৌখরী রাজবংশের সাথে শশাঙ্ককে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। পরবর্তীতে এই যুদ্ধ চতুষ্শক্তির যুদ্ধে পরিণত হয়।

একদিকে রাজা শশাঙ্কের ক্রমাগত বর্ধমান শক্তিকে ঠেকাতে এবং নিজেদের রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য থানেশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশের শক্তিশালী রাজা প্রভাকরবর্মনের পরমাসুন্দরী কন্যা রাজশ্রীর সঙ্গে কনৌজের রাজা গ্রহবর্মনের বিয়ের মাধ্যমে কনৌজ-থানেশ্বর রাজ্যের মধ্যে শক্তিশালী জোট গঠন করে।

অপরদিকে এই জোটকে শশাঙ্ক নিজের জন্য হুমকি মনে করে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মালব রাজ্যের রাজা দেবগুপ্তের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে নতুন জোট গঠন করে। প্রসঙ্গত তাছাড়া মালবের সঙ্গে থানেশ্বরের ঘোর বিরোধ ছিল। দুই রাজ্যই একে অপরকে ধ্বংস করার সুেযোগ খুজছিল।       

আরও পড়ুন- বাংলায় সেন শাসনের পতন এবং মুসলমানদের উত্থান  

এরপর রাজা শশাঙ্ক মগধ থেকে পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে বারানসী পর্যন্ত গঙ্গা নদীর উপকূল অধিকার করে কনৌজ রাজ্যকে অবরোধ করে। ইতিমধ্যে থানেশ্বর-কনৌজ জোটের দুর্বলতার সুযোগে রাজা শশাঙ্ক ও দেবগুপ্তের সম্মিলিত জোট কনৌজ রাজ্য আক্রমণ করে রাজা গ্রহবর্মণকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রী ও প্রভাকরবর্মণের বোন রাজশ্রীকে কনৌজে বন্দি করে।

এ সময় প্রভাকরবর্মনের মৃত্যু হলে তার জৈষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। অতপর রাজ্যবর্ধন তার বোন রাজশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য দশ হাজার অশ্বারোহী সহ ‍বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে কনৌজের দিকে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি প্রতিমধ্যে মালবের রাজা দেবগুপ্তকে পরাজিত করে হত্যা করে। কিন্তু রাজ্যবর্ধন কনৌজ দখল এবং ভগ্নীকে উদ্ধার করার পূর্বেই অপর যুদ্ধে শশাঙ্কের হাতে নিহত হন। তবে বিখ্যাত পন্ডিত ভানভট্ট ও হিউয়েন সাং এর মতে রাজা শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে শান্তি চুক্তির কথা বলে কনৌজের রাজদরবারে ডেকে নিয়ে এসে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তাকে হত্যা করে।

যাই হোক, রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর, তার অপর ভ্রাতা হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা হর্ষবর্ধন কাল বিলম্ব না করে ভগ্নী রাজশ্রীকে উদ্ধার করতে কনৌজের দিকে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং পৃথিবী গৌড়শূন্য অর্থাৎ শশাঙ্ককে ধ্বংস করার জন্য শপথ গ্রহণ করেন।                          

হর্ষবর্ধন

এসময় নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য হর্ষবর্ধন কামরুপের রাজা ভাষ্করবর্মনের মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে জোট গঠন করেন। প্রসঙ্গত এই কামরুপ রাজ ভাস্করবর্মনকে রাজা শশাঙ্ক প্রথমে পরাজিত করেছিলেন। ভাস্করবর্মণ শশাঙ্কের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হর্ষবর্ধনের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে।       

আরও পড়ুন- বাংলায় পাল শাসনের ‍উত্থান ও পতন   

অত:পর কনৌজে- গৌড় রাজ শশাঙ্ক এবং হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মনের জোটের মধ্যে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে শশাঙ্ক হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মন কর্তৃক দুই দিক থেকে আক্রন্ত হয়ে পরাজিত হন এবং কনৌজ ত্যাগ করে নিজের রাজ্য গৌড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর বিজয়ী হর্ষবর্ধন নিজের ভগ্নী রাজশ্রীকে উদ্ধার করেন এবং কনৌজকে নিজের রাজ্যভুক্ত করেন। এই বিজয়ের ফলে হর্ষবর্ধন তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম শক্তিশালী রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

অন্যদিকে এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে রাজ শশাঙ্কের ভাবমূর্তি ও মর্যদা ক্ষুন্য হয়।যদিও যুদ্ধের পরে আরও বেশ কয়েক বছর তিনি গৌড শাসন করে। অবশেষে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে গৌড় তথা বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি রাজা শশাঙ্ক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আর এভাবে একজন নারীর কারণে রাজা শশাঙ্কের পতন হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার পুত্র মানবদেবকে পরাজিত করে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন ও কামরুপ রাজ ভাস্করবর্মন গৌড় রাজ্য নিজেদের মাঝে ভাগ করে নেয়।

মগধ হর্ষবর্ধন এবং কর্ণসুবর্ণা ভাস্করবর্মনের রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে শশাঙ্কের প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন গৌড় রাজ্যের পতন ঘটে এবং বাংলার ঐক্যৈ বিনিষ্ট হয়ে সমগ্র বাংলা আবারও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

                                                           

পাল সাম্রাজ্য

অন্যদিকে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশ বছর বাংলার ইতিহাস প্রায় অন্ধকারচ্ছন্ন ছিল। এ সময় কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে বাংলায় ঘোর অরাজকতা, অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহি:শত্রুর আক্রমণ চলতে থাকে। বাংলার ইতিহাসে এ যুগকে অর্থাৎ সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীকে মাৎসন্যায় বা অরাজকতার যুগ বলে বিবেচিত করা হয়। সাগরের বড় মাছগুলো যেমন ছোট মাছদের শিকার করে খাদ্যে পরিণত করে, তেমনি তৎকালীন সময়ে বাংলার বৃহৎ রাজ্য গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে আক্রমণ করে দখল করত বলে এ যুগকে মাৎসন্যায় বলে অভিহিত করা হয়।        

আরও পড়ুন- বাংলায় গুপ্ত শাসনের উত্থান ও পতন

বাংলার এই অন্ধাকর ও অরাজকতাপূর্ণ সময়ে তিমির বিদারী হয়ে গোপাল নামের এক ব্যাক্তির আবির্ভাব ঘটে। তিনি অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে পুনরায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ফিরিয়ে এনে বাংলায় পাল রাজবংশের শাসন প্রতিষঠা করেন। বৌদ্ধধর্মাবলম্বি এই পাল রাজবংশ প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলা শাসন করেছিল।

ভিডিও দেখুন;


💻তথ্যের উৎস:

📌বাংলাদেশের ইতিহাস- কে আলী 📌বাংলাদেশের ইতিহাস- ড. মো: শাহাজাহান 📌বাংলার ইতিহাস- সূনিতী কুমার চট্টোপাধ্যায় 📌ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস- ড.এ.কে.এম আব্দুল আলীম 📌ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান 📌 উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন অনলাইন ওয়েবসাইট। 




 

                                                                        

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ