বাংলাদেশ, পাকিস্তান
এবং ভারত নামে বর্তমানে যে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে ১৯৪৭ সালে পূর্বে এ তিনটি দেশ
ভারতবর্ষ নামে পরিচিত ছিল। জনসখ্যার প্রাচুর্যতা এবং আয়তনেরর বিশালতার কারণে এটিকে
ভারতীয় উপমহাদেশ বলা হয়। তাছাড়া ভারতবর্ষকে ইন্ডিয়া এবং হিন্দুস্তান নামেও অভিহিত করা
হয়। সুপ্রাচীনকালে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতবর্ষ
বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জনপদ গুলোকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য যুগের সূচনা হয়। এরপর এই উপমহাদেশে গড়ে
উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য। অত:পর ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার
মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের অবসান হয়।
আরও পড়ুন: মুসলিম বিজয়পূর্ব ভারতবর্ষের ইতিহাস
কিভাবে ভারতীয় উপমাহদেশে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল? ভারতবর্ষের মহাজনপদসমূহ কি কি ছিল? কোন কোন সাম্রাজ্যে এই উপমহাদেশ শাসন করে? এবং কিভাবে ভারতবর্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্থান হয়? সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
সিন্ধু সভ্যতা
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিমে ইরান ও পাকিস্তান এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। আবার ভৌগোলিক দিক দিয়ে ভারতবর্ষকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- উত্তর ভারত তথা আর্যবত এবং দক্ষিণ ভারত তথা দাক্ষিণাত্য। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এই উপমহাদেশের সিন্ধু নদের অববাহিকায় এবং বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। এই সভ্যতার হরপ্পা ও মহেন্জোদারো নামে বিখ্যাত দুটি শহর ছিল। সিন্ধু প্রদেশ ছাড়াও এই সভ্যতা বর্তমান পাকিস্তানের পান্জাব এবং ভারতের পান্জাব, রাজস্থান ও গুজরাট রাজ্যে পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল।
ধারণা করা হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মধ্য এশিয়া থেকে আগত ইন্দো-ইউরোপিয় আর্য জাতীর আক্রমণের ফলে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের আর্যরা ভারতবের্ষ বৈদিক যুগের সূচনা হয়। প্রসঙ্গত কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে আর্যরা ছিল হযরত নূহ (আ) এর পুত্র ইয়াফিসের বংশধর। বেদ ছিল আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এই বৈদিক যুগে আর্য হিন্দুদের মধ্যে ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে জাতীবেদ প্রথা দেখা দেয়। তাছাড়া এই সময়ে অর্থাৎ আনুমানিক ১০০০ অব্দে রামায়ণ ও মাহভারত নামের দুটি মহাকাব্য রচিত হয়।
বৈদিক যুগের শেষের দিকে হিন্দু ধর্মে জাতি বেদ প্রথা ও বর্ণবৈষম্য জটিল আকার ধারণ করলে, বেধ বিরোধী ধর্মমতের উদ্ভব হয়। হিন্দু ধর্মের সহিংসতার বিরোদ্ধে এবং অহিংসার উপর ভিত্তি করে গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম, এবং পরবর্তীতে মহাবীর জৈন ধর্ম প্রবর্তন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে আর্য ও অনার্য জনগোষ্ঠির মধ্যে সংঘর্ষ এবং হিন্দু,বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের দ্বন্দের ফলে বৈদিক যুগের পতন হয়। এর পর সমগ্র ভারতবর্ষে প্রায় ১৬ টি মহাজনপদ গড়ে উঠে। মহাজনপদ সমূহ হলো- অঙ্গ, অবন্তী, অস্মক, কম্বোজ, কাশী, কুরু, কোশল, গান্ধার, চেদি, বজ্জি, বৎস, পাঞ্চাল, মচ্ছ, মল্য, মগধ এবং শূরসেন।
আরও পড়ুন: প্রাচীন বাংলার জনপদ সমূহ সম্পর্কে জানোন
এই জনপদ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল মগধ। এই মগধকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান হয়। মগধের রাজধানী ছিল পাটালিপু্ত্র, বর্তমানে যার অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনায়। প্রসঙ্গত মগধের অবস্থান বিহারে হওয়ায়, মগধ সাম্রাজ্যকে বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্ধ অংশ হিসেবেও বিবেচিত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬৮৪ অব্দে মগধে সর্বপ্রথম সাম্রাজ্য প্রতিষ্টা করে হর্য্যঙ্ক রাজবংশ। ৪১৩ অব্দে এই রাজবংশকে পরাজিত করে শিশুনাগ রাজবংশ মগধে শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ৩৪৫ অব্দে শিশুনাগ বংশকে ধ্বংস করে নন্দ বংশ মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
![]() |
মগধ সাম্রাজ্য |
নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দের শাসনামলে মদধ একিটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। নন্দ বংশের সর্বশেষ রাজা ধননন্দের শাসনামলে অর্থাৎ ৩২৭ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার হিন্দুকুশ পর্বতমালো অতিক্রম করে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে আক্রমণ করে। আলেকজান্ডার সিন্ধু নদী পার হয়ে প্রথমে তক্ষশীলা জয় করেন এরপর পশ্চিম ভারতের পৌরব রাজ্যের রাজা পুরুকে পরাজিত করেন। তখন রাজা ধন নন্দের বিশ হাজার অশ্বারোহী,দুই লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্যবাহিনী এবং চার হাজার রণহস্তি ছিল। তাই স্বয়ং আলেকজান্ডার মগধ সাম্রাজ্য আক্রমণের দুরাশা ত্যাগ করেন।
মগধের নন্দ বংশীয় শেষ রাজা ধননন্দ ছিলেন অত্যাচারী শাসক। তাকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে পরাজিত করে, মগধ দখল করে। তিনি গ্রিকদের থেকে পান্জাব, কাবুল, কান্দাহার এবং হিরাত পুনরুদ্ধার করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে মগধের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন: মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস
এটি ছিল ভারতের প্রথম শক্তিশালী সাম্রাজ্য। ২৯৮ অব্দে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তার পুত্র আশোক ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজত্ব শুরু করেন। সম্রাট অশোক দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ ব্যাতিত ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেন। তাই তাকে সর্বভারতীয় সম্রাট বলা হয়। ২৩২ অব্দে অশোকের মৃত্যুর পর তার দুর্বল উত্তরাধিকারীরা মৌর্য বংশের মর্যদা রক্ষা করতে ব্যার্থ হয়। অবশেষে গৃহযুদ্ধ, দাক্ষিণাত্য ও কালিঙ্গের রাজন্যবর্গ এবং গ্রীক যাযাবরদের আক্রমণের ফলে ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়।
মৌর্য
সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষে শুঙ্গ বংশের শাসনের সূচনা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৭ অব্দ
পর্যন্ত তাদের শাসন স্থায়ী ছিল। সুঙ্গ বংশের পতনের পর ভারতবর্ষে কুষাণ রাজবংশের শাসন
শুরু হয়। ৫০ খ্রিস্টাব্দে কুষাণ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুজুলা কদফিস গ্রিক ও পার্থিয়ানদের
পরাজিত কাবুল ও কান্দাহার সহ প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান দখল করেন। তার পুত্র বীম কদফিস
ভারতবর্ষে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
![]() |
কুষাণ সাম্রাজ্য |
কনিষ্ক কুষাণ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন।
এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পাকিস্তানের পেশওয়ার। ২৪০ খ্রিস্টাব্দে
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর আনুমানিক ২৮০ খ্রিস্টাব্দে মদধে গুপ্ত বংশের আবির্ভাব হয়।
তৃতীয় গুপ্ত রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এবং তার পুত্র সমুদ্র গুপ্ত ভারতবর্ষে বিশাল সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেন। ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মধ্য ভারতের পুষ্যমিত্র এবং মধ্য এশিয়ার হুন
জাতীর আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। অবশেষে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত
সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
আরও পড়ুন: গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ২৫০ বছর পর্যন্ত
ভারতবর্ষে আর কোন বৃহৎ স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠিত হতে পারে নি। এরপর সমগ্র ভারতবর্ষে বহুসংখ্যক
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব হয়। এই রাজ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল থানেশ্বর।
থানেশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশের রাজা প্রভাকরবর্ষণ হুন ও গুর্জার জাতীকে পরাজিত করে
থানেশ্বরে একটি শক্তিশারী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র হর্ষবর্ধন ছিলেন থানেশ্বরের
শ্রেষ্ঠ সম্রাট।
তিনি পান্জাব, সিন্ধু, কামরুপ ব্যাতিত সমগ্র উত্তর ভারত তার অধীনে নিয়ে আসেন। এমনকি তিনি গৌড়ের স্বাধীন রাজা শশাঙ্ককে পরাজিত করতে সক্ষম হন। তার পর আর কোন হিন্দু শাসক এত বৃহৎ রাজ্য শাসন করতে পারেন নি। তাই তাকে হিন্দু ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয়। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে অনেক গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের আবির্ভাব হয়।
![]() |
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য |
উত্তর ভারতের রাজ্যসমূহ হলো - কাশ্মীর, গুজরাট, কনৌজ, বুন্দেল ভন্ড, মালব, আজমীর ও দিল্লী, সিন্ধু এবং বাংলা। দক্ষিণ ভারতের রাজ্য সমূহ হলো- পল্ব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, পান্ড্য, চোলা, চেরা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত যখন হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণ বৈষম্য এবং প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজ্য সমূহের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ ও সংঘাতের ফলে তৎকালীন ভারতবর্ষে অরাজকতার পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তখন সাম্যে ও সম্প্রীতীর মহান বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইসলামের নিশানা উড়িয়ে মুসলীম বীর সেনানীরা ভারতবর্ষে আগমন করে।
আরও পড়ুন: মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের বীরগাঁথা ইতিহাস
এরই প্রেক্ষাপটে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বীর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবের্ষ মুসলিম বিজয়ের সূচনা করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে আফগান বীর সুলতান মাহমুদ সমগ্র ভারতবের্ষ অভিযান প্রেরণ করেন, ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মুইযুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লী ও আজমীর বিজয় করে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কী বীর সেনানী বখতিয়ার খলজী নদীয়া ও গৌড় তথা লখনৌ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শানের গোড়াপত্তন করে। সর্বপরি ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মধ্যযুগের সূচনা হয়।
ভিডিও দেখুন:
তথ্যের উৎস :
📘 ভারতবর্ষের ইতিহাস - ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান
📘 ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস – এ.কে.এম আবদুল আলীম
📘 মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায় – শাহাদাত হোসেন খান
📘 ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস – ড. মুহাম্মদ ইনামুল হক
📘 ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ গোলাম রসূল
📘 ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন – আব্দুল করিম
📘 মুঘল ভারতের ইতিহাস – মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান
📘 মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস – অনিরুদ্ধ রায়
📘 উইকিপিড়িয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ব্লগ ও অনলাইস ওয়েব সাইট
0 মন্তব্যসমূহ