আরও পড়ুন: আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস (৭৫০-৮৪২খ্রি.) ও খলিফাদের বংশ তালিকা
ইসলামের ইতিহাসে খেলাফতের শাসন ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ৬৩২ খ্রি. মহানবীর (স) ইন্তেকালের পর ইসলাম ধর্ম, মুসলিম জাতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে খেলাফতের শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। আর যিনি এই খেলাফত ব্যবস্থা ও মহানবীর (স) প্রতিনিধিত্ব করেন তাকে বলা হয় খলিফা। ইসলামের প্রথম খেলাফত হলো রাশেদিন খেলাফত এবং প্রথম খলিফা হলেন হযরত আবু বকর (রা)।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আবু বকর (রা) এর লাভ থেকে শুরু করে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ খলিফা আলী (রা) এর শাহাদাৎ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের শাসনকালকে রাশেদিন খিলাফতের শাসনকাল বলে অভিহিত করা হয়। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলী (রা) এর ওফাতের পর, তার পুত্র হাসান (রা), এক সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে মুয়াবিয়া (রা) কে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
মুয়াবিয়া (রা) এর খেলাফত লাভের মধ্যদিয়ে রাশেদিন খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং উমাইয়া খেলাফতের উত্থান হয়। মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা বংশানুক্রমিক ছিল বলে এটিকে উমাইয়া রাজবংশও বলা হয়। উমাইয়া খেলাফতের ১৪ জন খলিফা ৬৬১ খ্রি. থেকে ৭৫০ খ্রি. পর্যন্ত গৌরবের সাথে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছিল। উমাইয়া খলিফাদের বংশ তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
আরও পড়ুন:আবু বকরের (র) খেলাফত লাভের ইতিহাস
উমাইয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মুয়াবিয়া (রা) মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। সেক্ষেত্রে মহানবী (স) এর বংশধারার সাথে মুয়াবিয়া (রা) এর বংশের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। কেননা মহানবী (স) ও কুরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ করেছেন। যদিও মহানবী (স) এর গোত্র ছিল হাশেমী। গত ভিডিওতে আপনাদের জানিয়েছি, হযরত আদম আ থেকে ফিহর তথা কুরাইশ এবং কুরাইশ থেকে মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত বংশধারাক্রম।
![]() |
কুরাইশ বংশ |
মূলত কুরাইশের পাঁচ বংশধারাক্রমের পরের বংশধর হলেন আব্দে মানাফ। আব্দে মানাফের সন্তানদের মধ্যে বিখ্যাত দুই জন ছিলেন আব্দুস শামস এবং হাশেম। হাশেম থেকে হাশেমী গোত্রের উৎপত্তি ও নামকরণ করা হয়। এই গোত্রে মহানবী (স) এবং চতুর্থ ও শেষ রাশেদিন খলিফা আলী (রা) জন্মগ্রহণ করেন।
আর আব্দুস শামসের পুত্র উমাইয়া থেকে বিখ্যাত উমাইয়া গোত্রের নামকরণ ও উৎপত্তি হয়। ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা) এবং উমাইয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া (রা) এই গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। উমাইয়ার সন্তানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হারব এবং আবুল আস। হারবের পুত্র এবং মুয়াবিয়া (রা) এর পিতা ছিলেন মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান। আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী হিন্দা এক সময় ইসলাম ও মহানবী (স) এর চরম শত্রু ছিলেন। কিন্তু ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের উপর তারা উভয়ে পরিবারসহ মহানবীর (স) নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন।
আরও পড়ুন: রাশেদুন খিলাফতের ইতিহাস ও খলিফাদের বংশ তালিকা
আবু সুফিয়ানের পুত্র ও উমাইয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া (রা) ও এই সময় ইসালাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মহানবী (স) এর ওহী লেখক হিসেবে যোগদান করেন। মহানবীর (স) ইন্তেকালের পর মুয়াবিয়া (রা) রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি হযরত উমরের (রা) খেলাফতকালে দামেস্কের প্রশাসক, উসমান (র) এর সময়ে সিরিয়ার শাসনকর্তা এবং আলী (রা) শাসনকালে মিসর ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের চতুর্থ এবং সর্বশেষ রাশেদীন খলিফা আলী (রা) ইন্তেকালের পর খেলাফত প্রশ্নে মুসলিম বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত যায়। একপক্ষ আলী (রা) এর জৈষ্ঠ্য পুত্র হাসানকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করে। অপর পক্ষ মুয়াবিয়া (রা) কে। খেলাফতের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে ফাটল দেখা দিলে মুয়াবিয়া (রা) হাসান (রা) এর সাথে একটি সন্ধি চুক্তি করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে হাসান (রা) মুয়াবিয়া (রা) কে খেলাফতের দায়িত্ব প্রদান করেন। মুয়াবিয়া (রা) এর পূর্বপুরুষ উমাইয়ার নাম অনুসারে তার প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের নামকরণ করা হয় উমাইয়া খেলাফত নামে।
![]() |
উমাইয়া খিলাফত ম্যাপ |
আর এভাবে রাশেদিন খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মুয়াবিয়া (রা) এর নেতৃত্বে উমাইয়া খেলাফতের উত্থান হয়। উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী ছিল সিরিয়ার দামেস্ক। মুয়াবিয়া (রা) ৬৬১ থেকে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। মুয়াবিয়া (রা) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা মনোনিত করার মাধ্যমে, রাশেদিন খিলাফতের গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকে বিলুপ্ত করে, ইসলামের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত করেন।
আরও পড়ুন:কুরাইশ গোত্রের বংশ তালিকা
দ্বিতীয় উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ৬৮০ থেকে ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামলের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হলো কারবালার প্রান্তরে আলী (রা) কনিষ্ঠ পুত্র ইমাম হুনাইনের পরিবারবর্গসহ হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডের ফলে শিয়া মতবাদের জন্ম হয়, যা পরবর্তী ইসালামী বিশ্বের জন্য বড়ধরনের হুমকি হয়ে দাড়িয়েছিল। এমনকি বর্তমান মুসলিস বিশ্বও শিয়া-সুন্নি দ্বন্দের ফল ভোগ করছে। তাছাড়া এই ঘটনার ফলে ইসলামে খেলাফতের ঐক্যে ফাটল ধরে।
৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার খেলাফতকালে সমগ্র উমাইয়া খেলাফতে বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। রুগ্ন ও নম্র স্বভাবের এই খলিফা মাত্রা তিন মাস শাসনকার্য পরিচালনা করে ইন্তেকাল করেন। মূলত তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে উমাইয়া রাজবংশের সুফিয়ানিদ শাখার শাসনের অবসান ঘটে এবং হাকামীয় শাখার শাসনের উত্থান ঘটে।
৬৮৪ খ্রি. চতুর্থ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর মারওয়ান সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি ৬৮৪-৬৮৫ খ্রি. পর্যন্ত একবছর রাজত্ব করেন। খলিফা মারওয়ান ছিলেন উমাইয়ার পৌত্র আল হাকামের পুত্র। তাই মারওয়ানের বংশের খলিফাদের হাকামীয় শাখার খলিফা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ৬৮৫ খ্রি. মারওয়ানের ইন্তেকারের পর তার জৈষ্ঠ্য পুত্র আব্দুল মালিক উমাইয়া খেলাফতের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ৬৮৫ খ্রি. থেকে ৭০৫ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর রাজত্ব করেন।তিনি পতনম্মুখ উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিদ্রোহ ও বিচ্ছৃঙ্খলা দম করে এবং হারানো রাজ্যসমূহ পুনরুদ্ধার করে উমাইয়া শসনকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করতে সক্ষম হন। তাই খলিফা আব্দুল মালিককে উমাইয়া রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
আরও পড়ুন: মহানবীর (স) বংশ তালিকা
খলিফা আব্দুল মালিককে রাজেন্দ্র অর্থাৎ Father of the Kings ওবলা হয়। কারণ তার চারজন সুযোগ্য পুত্র প্রথম ওয়ালিদ, সুলাইমান, দ্বিতীয় ইয়াজিদ এবং হিশাম পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মালিকের মৃত্যুর পর তার জৈষ্ঠপুত্র ওয়ালিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। খলিফা আল ওয়ালিদকে শ্রেষ্ঠ বিজেতা বলা হয়। তার রাজত্বকালে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলিত হয়। হাজ্জাজ, মূসা, কুতাইবা, মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং তারিক বিন জিয়াদের মত শ্রেষ্ঠ বীরদের নেতৃত্বে তখন বিশ্ব জুডে ইসলামের বিজয়ধ্বনি কম্পিত হয়েছিল।
৭১৫ খ্রিস্টাব্দে
খলিফা আল ওয়ালিদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা সুলাইমান খেলাফত লাভ করেন। খলিফ সুলাইমানের
শাসনকালে মুসলমানরা তৃতীয়বার কনস্টান্টিানোপলে বিরোদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে, যদিও
অপর দুই অভিযানের মত এটিও ব্যার্থ হয়। প্রসঙ্গত মুয়াবিয়া (রা) এর খেলাফতকালে দুইবার
কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিল।
৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সুলাইমানের ইন্তেকালের পর , তার মনোনয়ন অনুসারে খেলাফতের দায়িত্বলাভ করেন তার চাাচতো ভাই ওমর ইবনুল আব্দুল আজিজ। তিনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর হিসেবে বেশ পরিচিত। তার পিতা ছিল হাকামীয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা মারওয়ানের দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল আজিজ। সরল, অনাড়ম্বর, ন্যায়নিষ্ঠা, ধর্মানুরাগী সহনশীল এবং রাশেদিন খলিফাদের জীবনাদর্শ উদ্ধুদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করতেন বলে দ্বিতীয় ওমরকে পঞ্চম ধর্মপ্রাণ খলিফা এবং উমাইয়া সাধু পুরুষ বলা হয়।
আরও পড়ুন: মহানবীর (স) বংশ তালিকা : আদম (আ) থেকে মুহাম্মদ (স)
৭২০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ওমরের ইন্তেকালের পর আবুল মালিকের পুত্র দ্বিতীয় ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের ইন্তেকালের পর , আব্দুল মালিকের অপর পুত্র হিশাম খেলাফত লাভ করেন। প্রসঙ্গত খলিফা হিশামের পৌত্র আব্দুর রহমান আদ দাখিল ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে উমাইয়া আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন।
দশম উমাইয়া খলিফা হিশাম ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করলে, তার ভ্রাতা দ্বিতীয় ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় ওয়ালিদ ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু একই বছর তার মৃত্যুর পর খলিফা ওয়ালিদের পুত্র তৃতীয় ইয়াজিদ এবং তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা ইব্রাহিম সিংহাসন লাভ করেন। অর্থাৎ ৭৪৩ থেকে ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারজন উমাইয়াা খলিফা সিংহাসনে আরোহণ করেন।
![]() |
আব্বাসীয় খিলাফত |
৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ উমাইয়া খলিফা ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন চতুর্দশ ও শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান। তার পিতা মুহাম্মদ ছিলেন চতুর্থ উমাইয়া খলিফা মারওয়ানের তৃতীয় পুত্র। দ্বিতীয় মারওয়ানের রাজত্বকালে ইরাক ও খোরাসানে, মহানবী (স) এর চাচা আব্বাসের বংশধররা, উমাইয়া খলিফাদের দমন-পিড়ন এবং অনৈসলামিক কার্যকলপারে অভিযোগে, উমাইয়া বিরোধী আব্বাসীয় আন্দোলনের সূচনা করে।
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে আবুল আব্বাস আসসাফার নেতৃত্বে এই আন্দোলন চূড়ান্ত লাভ করে। খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান আব্বাসীয় আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করলে, জাব নদীর তীরে উভয় পক্ষের মধ্যে ৭৫০ খি. সংঘটিত হয় ঐতিহাসেক জাবের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান আব্বাসীয়দের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দামেস্ক কেন্দ্রেকী উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে এবং আবুল আব্বাস আসসাফার হাত দরে বাগদাদ কেন্দ্রীক আব্বাসী খেলাফতের উত্থান হয়।
0 মন্তব্যসমূহ