ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আদম (আ) থেকে ফিহর তথা কুরাইশ পর্যন্ত বংশপরিক্রমায় মোট ৭৯ জন এবং আদম (আ) থেকে মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত মোট ৯০ জন বংশধরের নাম ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। হযরত আদম এবং হাওয়া (আ) এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানবজাতীর বংশবৃদ্ধির সূত্রপাত করেন। আদম (আ) এর পুত্র হাবিল এবং কাবিলের মধ্যে সংঘাত বাধলে, একপর্যায়ে ছোটভাই হাবিলকে কাবিল হত্যা করে। ফলে মানবজাতীর বংশপরিক্রমা হযরত আদম (আ) এর তৃতীয় পুত্র শীষ (আ) মাধ্যমে চলতে থাকে।
হযরত শীষ (আ) এর চার বংশধর পর হযরত ইদ্রীস (আ) বংশপরিক্রমার সূচনা হয়। ইদ্রীস (আ) এর দুই বংশধর পর নূহ (আ) এর অবস্থান। হযরত নূহ (আ) সময় পথভ্রষ্ট মানবজাতীর উপর মহান আল্লাহ মহাপ্লাবনের মাধ্যমে পৃথিবীতে গজব নাযিল করেন। ফলে নূহ আ এর অনুসারী সহ সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র যে সব মানুষ কিংবা প্রাণী নুহ (আ) এর নৌকায় আরোহণ করেছিল, মহান আল্লাহর ইচ্ছাই তারাই বেঁচে ছিল।
আরও পড়ুন: রাশেদুন খিলাফতের ইতিহাস (৬৩২-৬৬১ খ্রি.) ও খলিফাদের বংশ তালিকা
তার পুত্রদের মধ্যে হাম, সাম এবং ইয়াফিজ নৌকায় আরোহণ করাই তারা বেঁচে যায়। কিন্তু অপর পুত্র ইয়াম তথা কেনান এবং স্ত্রী পানিতে ডুবে মারা যায়। তাই মানবজাতীর পুনরায় বংশধারাক্রমের সূচনা হয়, নুহ আ: এর অপর তিন পুত্র থেকে। তার মধ্যে সামের বংশধারক্রম থেকে আরবজাতীর উৎপত্তি। নূহ (আ) এর দুই বংশধর পর আসে হুদ (আ)।
হুদ (আ) এর ছয় বংশধরের পরের জন হলেন আজর। আজর ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ) এর পিতা।ইব্রাহীম (আ) এর বংশধর থেকে নাসাঈ তথা খ্রিস্টান জাতির কাছে ইসলাম প্রচারক ঈসা (আ), , ইহুদি তথা বনি ইসরাইল জাতির কাছে ইসরাম ইয়াকুব (আ) এবং মুসলিম জাতির কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুহাম্মদ (স) এর আবির্ভাব ঘটে। তাছাড়া ইব্রাহীম (আ) এর বংশধরদের থেকে মহান আল্লাহ সবচেয়ে বেশী সংখ্যক নবী-রাসূল প্রেরন করেন। তাই ইব্রাহীম (আ) কে জাতীর পিতা বলা হয়।
![]() |
আদম (আ) থেকে কুরাইশ |
হযরত ইব্রাহীম (আ) এর পর বংশধারা তার পুত্র ইসমাইল (আ) এর মাধ্যমে চলে । এরপর ইসমাইল (আ) এর আটত্রিশমত বংশধরের পর আসে আদনান। আদনান থেকে মূলত কুরাইশ বংশের উৎপত্তি। আদনানের নয় বংশধর পর আসে ফিহর। ফিহরের অন্যনাম ছিল কুরাইশ। তিনি ইতিহাসে কুরাইশ নামে বিখ্যাত হয়ে আছেন। আর এই কুরাইশের নাম থেকে মক্কার কুরাইশ বংশের নামকরণ করা হয়।
আরও পড়ুন: উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) ও বংশ তালিকা
ফিহরের দুই বংশধরের পর আসে কা’ব। কা’বের পুত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিল আ’দী,তায়িম এবং মুররা। তায়িম থেকে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) তায়িম বংশ এবং আ’দী থেকে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) এর আ’দ বংশের উৎপত্তি হয়। অন্যদিকে মুর’রার দুই বংশধরের পর আসে আব্দে মানাফ। আব্দে মানাফের পুত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আব্দুস শাসস এবং হাশিম।
আব্দুস শামসের পুত্র ছিলেন উমাইয়া। উমাইয়ার নাম থেকে উমাইয়া বংশের নামকরণ এবং উৎপত্তি হয়। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা) উমাইয়া গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। অপরদিকে আব্দে মানাফের অপর পুত্র হাশিম থেকে হাশিম গোত্রের নামকরণ ও উৎপত্তি হয়। হাশেমি গোত্রে মুহাম্মদ (স) এবং চতুর্থ খলিফা আলী (রা) জন্মগ্রহণ করেন। তাছাড়া আব্বাসীয় বংশের উৎপত্তিও হয় এই হাশেমী গোত্র থেকে। ইসলামের ইতিহাসের কলঙ্খিত অধ্যায় প্রাক-ইসলামী এবং ইসলাম পরবর্তী যুগে উমাইয়া হাশেমী দ্বন্দ বলতে মূলত এই গোত্রদ্বয়ের মধ্যে দ্বন্দ-সংঘতকে বুঝাতে।
হাশিমের পুত্র ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন মহানবী (স) এর দাদা এবং তৎকালীন মক্কার রক্ষক। আব্দুল মুত্তালিবের পুত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- হযরত হামযা (রা), আব্বাস (রা), আব্দুল্লাহ, আবু তালেব এবং আবু লাহাব। মহানবী (স) এর চাচা হযরত হামযা (রা) উহুদের যুদ্ধে ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছিলেন, চাচা আবু লাহাব মহানবী (স) এবং ইসলামের চিরশত্রু ছিলেন। চাচা আব্বাস (রা) এর বংশধরদের থেকে আব্বাসীয় খেলাফতের উৎপত্তি হয়। চাচা আবু তালেব ছিলে চতুর্থ খলিফা আলী (রা) এর পিতা এবং মহানবী (স) এর অন্যতম অবিভাবক। আর আব্দুল্লাহ ছিলেন মুহাম্মদ (স) এর পিতা এবং মাতা ছিলেন আমেনা।
আরও পড়ুন: আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস (৭৫০-৮৪২ খ্রি.) ও বংশ তালিকা
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (স) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পূর্বে পিতা আব্দুল্লাহ এবং জন্মের ছয় বছর পর অর্থাৎ ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাতা আমেনা মৃত্যুবরণ করে। এরপর দাদা আব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মদ (স) এর ভরণপুষনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব মুহাম্মদ (স) এর অভিভাবক নিযুক্ত হন। আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ না করলেও সূখে-দু:খে সর্বদা মুহাম্মদ (স) এর পাশে ছিলেন।
অন্যদিকে মহানবী (স) এর তিন পুত্র কাসিম, আব্দুল্লাহ এবং ইব্রাহীম শৈশবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর চার জন কন্যাদের মধ্যে জয়নব (রা) এর বিবাহ হয় আবুল আসের সঙ্গে। রুকেয়া এবং উম্মে কুলসুমের সাথে হযরত উসমান (রা) এর বিবাহ হয় বলে, তাকে জুন-নুরাইন বা দুই জুতির অধিকারী বলা হয়। অপর কন্যা ফাতেমা (রা) এর বিবাহ হয় মহানবীর (স) চাচাতো ভাই ও চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) সাথে।
![]() |
মহানবী (স) এর বংশ তালিকা |
ইতিহাসে মহানবীর (স) এর বংশধর বলতে সাধারণত হযরত ফাতেমা এবং আলী (রা) বংশধরদের নির্দেশ করে। হযরত আলী (রা) এবং ফাতেমা (রা) এর দুই সন্তান হাসান এবং হোছাইন। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলী (রা) এর ওফাতের পর তার পুত্র হাসান (রা) এক সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে মুয়াবিয়া (আ) কে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুয়াবিয়া (রা) এর খেলাফত লাভের মধ্যদিয়ে রাশেদিন খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং উমাইয়া খেলাফতের উত্থান হয়।
অন্যদিকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর আব্বাসীয় খেলাফতের অভূত্থান ঘটে। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফতেরও পতন ঘটে। এরপর আরও বেশ কয়েকশ বছর আব্বাসীয় খেলাফত টিকেছিল, মিশরের মামলুক সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায়। অবশেষে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম মামলুকদের পরাজিত করলে মিশর,সিরিয়া, মক্কা-মদিনা সহ সমস্ত আরব অঞ্চলে উসমানীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর শেষ আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল সুলতান প্রথম সেলিমের নিকট খেলাফতের দায়িত্ব হাস্তান্তর করেন। সর্বশেষ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
আরও পড়ুুন: আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস (৮৪২-৯৪৬ খ্রি.) ও বংশ তালিকা
ভিডিও দেখুন
0 মন্তব্যসমূহ