নিজামুল মুলক আত তুসী | ইসলামী সভ্যতার মহান সংস্কারক |

                                                      

      আরও পড়ুন: সুলতান আল্প আরসালানের জীবনী

ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যারা বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে এই সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। নিজামুল মুলক আত তুসী এই মনীষীদেরই একজন, যিনি পরপর দুজন সেলজুক সুলতান, আলপ আরসালান এবং তাঁর পুত্র সুলতান মালিক শাহের অধীনে পূর্ণ ৩০ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাঁর মতো রাষ্ট্রীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাসে প্রায় বিরল। তাছাড়া তিনি তাঁর গুরুতর প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে ছিলেন একজন বিদ্বান পুরুষ। তিনি ইসলামের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার উপর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হন।

নিজামুল মুলকের প্রকৃত নাম আবু আলী আল-হাসান ইবনে আত-তুসি। তিনি ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তের নিকটে তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল হাসান। সেলজুক সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সুলতান মালিক শাহ উজির হাসানকে নিজামুল মুলক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ৷ শৈশব থেকে তিনি ফারসির পাশাপাশি আরবী ভাষার শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং কুরআন, হাদিস,ফিকাহ শাস্ত্র ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন।

গজনী সাম্রাজ্য

জীবনের প্রথম দিকে নিজামুল মুলুক আফগানিস্তানের গজনীতে গজনী সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্মে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সে-সময় সেলজুকদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটছিল এবং তারা গজনীদের হটিয়ে খোরাসানের অঞ্চলগুলোতে অর্থাত বর্তমানের আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ইরাকে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

হাসান তুসীর দক্ষতা, জ্ঞান এবং বুদ্ধি বাদশাহ আলপ আরসালানের মন্ত্রী আবু আলী বিন শাযানকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি পরবর্তীতে সেলজুক সুলতান আলপ আরসালানের ‘কাতেবে’র পদে উন্নীত হন। সুলতান আলপ আরসালান যখন ঐতিহাসিক ‘মানযিকার্ট’-এর যুদ্ধে বিজয়ী হন, তখন তিনি তাঁর কাতেব হাসান তুসিকে সেলজুক রাজ্যের উজির বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

আলপ আরসালান ও তার পুত্র মালিকশাহ, এই দুই সেলজুক শাসকের অধীনে নিজামুল মুলক দীর্ঘ তিরিশ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। নিজামুল মুলকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আব্বাসি ও সেলজুকদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সমর্থ হন। রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কাজকর্মেও নিজামুল মুলক অংশ নিতেন। সৈন্যবাহিনীকে ঢেলে সাজানো ও অধিক শক্তিশালী করার ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। এমনকি তিনি যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের অগ্রভাগে থেকে লড়াই করতেন।

আরও পড়ুন:সুলতান মালিক শাহ সম্পর্কে জানোন

রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অনুপম দক্ষতার মাধ্যমে তিনি ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। সাধারণ মানুষের প্রতি নিজামুল মুলক খুবই আন্তরিক ছিলেন। তারা যাতে জুলুম বা অত্যাচারের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিজামুল মুলক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। রাষ্ট্রসংক্রান্ত তার এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে তিনি ‘সিয়াসাতনামা’নামে একটি গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন। এই সিয়াসতনামা গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে সুলতান মালিক শাহ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান রচনা করেন।                    

সিয়াসতনাাম 
এশিয়ায় বিস্তৃত সেলজুক সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘ দূরত্ব থাকার কারণে দ্রুত সংবাদ পৌঁছানোর জন্য নিজামুল মুলুক ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তুর্কি সেলজুকদের উত্থানের পূর্বে সুন্নি আব্বাসি খেলাফতকে নিয়ন্ত্রণ করতো শিয়া পন্থি বুহাইরিয়ারা। তারা ইরাক ও ইরানে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং শিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তাধারা মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এর পাশাপাশি মিশরের ফাতেমি সাম্রাজ্য শিয়া ইসমাঈলি মতবাদ প্রচারের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে থাকে।

আব্বাসি ও সেলজুকদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে আহলুস সুন্নাহর শক্তিশালী ভিত্তি দুর্বল করার জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে৷ সে-সময় হাসান সাব্বাহর নেতৃত্বে ইসমাইলি বাতেনী হাশশাশীদের আত্মপ্রকাশ ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক বিষয়। তাদের দুর্গগুলো ইরান ও শামের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

বড় বড় আলেম ও আমিরদেরকে এবং যাদেরকে তারা নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের পথে বাধা মনে করতো, তাদেরকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে হত্যা করতো৷ দুর্ভেদ্য দুর্গ ও তাদের অনুসারীদের সাহায্যে তারা ইরানের দামেগান, আলমুতসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল মানুষকে তাদের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। শামের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মতবাদ৷

আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস

এই ভ্রান্তদল ও মতবাদকে সমূলে উতপাটন করতে নিজামুল মুলুক সামরিক অভিযানের পাশাপাশি বুদ্ধিভিত্তিক পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। তিনি তাদের মোকাবিলার জন্য বাগদাদ, বসরা, ইস্পাহান, বলখ, হেরাত, মার্ভ এবং মসুলসহ সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যজুড়ে নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।         

নিজামিয়া মাদ্রাসা
বিভিন্ন বাতিল ফেরকা ও ইসমাইলি শিয়া মতবাদকে রদ করার জন্য নিজামুল মুলক নিজামিয়া মাদরাসার আলেমদেরকে শিয়াদের বিরোদ্ধে লেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন৷ যাতে করে এই লিখিত গ্রন্থসমূহ ভ্রান্ত আকিদার ভুল প্রমাণ করে দেয়। বাতিল ফেরকাগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো ইমাম গাযালির বিখ্যাত গ্রন্থ ``রিসালা। শিয়াদের মতবাদের বিরোদ্ধে জ্ঞানের যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য নিজামুল মুলুক ইমাম গাজ্জালীকে প্রথমে বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় এবং পরে ইস্পেহানের নিজামিয়া মাদ্রাসায় যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি গ্রহণ করেন।

ইসমাইলি মতবাদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মাদরাসায়ে নিজামিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ সেইসাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান বিজ্ঞান ও সঠিক আকিদা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। নিজামুল মুলুকের পৃষ্ঠপোষকতায় ততকালীন বিখ্যাত জোত্যির্বিদ ও বহু প্রতিভার অধিকারী উমর খৈয়াম একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করেন। তার এই কেন্দ্রটি সমকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক কেন্দ্রগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল। 

উমর খৈয়াম
এখানে বসেই উমর খৈয়াম প্রায় নির্ভুলভাবে তার সৌর ক্যালেন্ডারটি তৈরি করেছিলেন। যেটি সেলজুকি বা জালালী দিনপঞ্জি নামে পরিচিত। ইসমাইলী শিয়া মতবাদকে ধ্বংস করতে নিজামুল মুলকের অসাধারণ সাফল্য, প্রবল বুদ্ধিমত্তা, রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা, বিস্তৃত জ্ঞান, ও ন্যায়পরায়ণতা দেখে ইসমাইলি বাতেনিরা তার উপর প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হতে থাকে।                              

অবশেষে ইসমাইলি শিয়াপন্থি হাসান সাব্বাহর এক অনুসারি দরিদ্র সেজে এসে নিজামুল মুলকের কাছে তার উপর অত্যাচারের অভিযোগ জানায়। নিজামুল মুলক যখনই তার কাছাকাছি হলেন তখন অভিযোগকারী ব্যক্তিটি তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয়। চুরির আঘাতে নিজামুল মুলক আত তুসী ততক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ১০৯২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ৪৮৫ হিজরীর দশম রমজানে নেহাওয়ান্দ শহরের কাছে।

পরে তার মৃতদেহ ইস্পাহানে নিয়ে আসা হয় ৷ এবং ইস্পেহান শহরে তার প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদরাসায় তাকে দাফন করা হয়। ইসলামী সভ্যতার অন্যতম ধারক ও বাহক নিজামুল মুলুকের মৃত্যুর মাধ্যমে পতন হয় ইসলামী সভ্যতার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের, যা আর কোন দিন উদিত হয় নি।

আরও পড়ুন:বাতেনী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হাসান সাব্বাহর জীবনী

  ভিডিও দেখুন:

               

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ