হিজরি সপ্তম শতাব্দী।
মোঙ্গলীয়দের আক্রমণে লণ্ডভণ্ড আব্বাসীয় খেলাফত । কনস্টান্টিনোপলের খ্রিষ্টানদের
সাথে লড়াইয়ে রোমের সালজুক সালতানাতের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। ইসলামি ইতিহাসের এক চরম
দুর্যোগপূর্ণ সময়। ঠিক এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে হেসে ওঠে
এক নবারুণ সূর্য। দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে সেই সূর্যের দীপ্তি। ইসলামি সাম্রাজ্যের
মেঘলা আকাশকে স্বচ্ছ এবং প্রখর রোদের আকাশে পরিণত করা সেই সূর্যের নাম ‘উসমানি
সালতানাত’।
আরও পড়ুন: আব্বাসীয় খেলাফতের ইতিহাস
ইসলামি ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায় জুড়ে ছড়িয়ে যে সালতানাতের ব্যাপ্তি। যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী দোর্দণ্ড প্রতাপের এবং ন্যায়নিষ্ঠার সাথে শাসন করে গেছেন মুসলিম বিশ্ব। একের পর এক রাজ্য বিজয় করে ইসলামকে করেছেন সমুন্নত এবং সম্প্রসারিত। সারা বিশ্ব যাদেরকে জানে ‘অটোমান সাম্রাজ্য’ নামে। দীর্ঘকাল যাদের কথা চর্চা হয়ে আসছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
কীভাবে উত্থান হলো এই মহা শক্তিশালী সালতানাতের? কী তাদের পরিচয়? কোথা থেকে তাদের আগমন? কীভাবে এই সাম্রাজ্য তিন মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল? কীভাবে উসানীয় সাম্রাজ্য খেলাফতে পরিণত হলো? আর কীভাবেই বা এ মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্যের পতন হলো? কীভাবে ধ্বংস হলো শত শত বছরের খিলাফতব্যবস্থা? সে সম্পর্কে জানতে এই প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
তের শতকের শেষ ভাগে ওঘুজ তুর্কী গোত্র নেতা ওসমান গাজীর হাত ধরে আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে যাত্রা শুরু করে উসমানীয় সাম্রাজ্য। ইতিহাস বিখ্যাত এ সাম্রাজ্য পৃথিবীর বুকে টিকে ছিলো প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয় এবং বলকান অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে একটি আন্তঃমহাদেশীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে কনস্টান্টিনোপল জয়ের মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটান উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ।
আরও পড়ুন: সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান
ইতিহাস বিখ্যাত
উসমানীয় সুলতান সুলাইমানের পিতা সুলতান সেলিম ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মারজ-ই-দাবিকের
যুদ্ধে মামলুক সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে আরব দেশ সমূহ জয় করেন। এবং তখনকার আব্বাসীয়
খলিফা থেকে খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। মূলত সুলতান সেলিমের শাসনামল থেকে উসমানীয় সাম্রাজ্য
উসমানীয় খেলাফত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং প্রতিটি উসমানীয় সুলতান খলিফার দায়িত্ব
পালন করত।
উসমানীয় সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার সোনালী সময়টি পার করেছে অবশ্য ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের সময়কালটিতে। তখন তাদের নেতা হিসেবে সিংহাসনে আসীন ছিলেন সুলতান প্রথম সুলাইমান। তখন এটি একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্র্যাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ, মধ্য ইউরোপের কিছু অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া, ককেশাস অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং হর্ন অফ আফ্রিকা বলে পরিচিত উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার উপদ্বীপের উপর ছিলো তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
সুলতান সুলাইমানের সময় সাম্রাজ্য
আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাত
আঠারো শতকের
মাঝামাঝি সময়ে এসে অবশ্য দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। প্রায় সাড়ে চারশ বছর বয়সী এ
সাম্রাজ্যেটিও যেন তখন বয়সের ভারে ন্যুজ হওয়া শুরু করেছিলো। ইউরোপীয় প্রতিপক্ষ
রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও অস্ট্রিয়া কেন্দ্রিক হ্যাবসবুর্গ সাম্রাজ্য, ফরাসি সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তুলনায়
তাদের সামরিক শক্তি ততদিনে হ্রাস পাওয়া শুরু করেছিলো। এরই ফলস্বরুপ আঠারো শতকের
শেষ এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে বেশ কিছু যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে হয় তাদের।
পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পাবার আশায় জার্মানীর সাথে বন্ধুত্বের হাত মেলায় তারা। অবশ্য ততদিনে উসমানীয় সাম্রাজ্যের ঘরের ভেতরেও আগুন লেগে গিয়েছিলো। বিশেষ করে উসমানীয়দের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া আরব বিদ্রোহ বেশ ভালোই ঝামেলা তৈরি করেছিলো সাম্রাজ্যটির অগ্রযাত্রার পথে। আর্মেনিয়া, গ্রীস ও বলকান উপদ্বীপের দেশ সমূহের স্বাধীনতা ঘোষণা সাম্রাজ্যটিকে চরম খারাপ পরিস্থিতিতের মুখে ঠেলে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
পরাজয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হবার পথে চূড়ান্ত ভূমিকাটি পালন করলো।
এরপর তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলই হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। প্রায় ছয়শ বিশ বছরের
বৃদ্ধ অটোম্যান সাম্রাজ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত কবর খুঁড়েছিলো তুর্কীদের স্বাধীনতা
যুদ্ধ। এই যুদ্ধে
তুর্কিদের নেতৃত্বে ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রভাবিত মুস্তাফা কামাল
আতাতুর্ক। এ যুদ্ধে তুর্কীদের বিজয়ই বিশ্বে উসমানীয় সুলতানী শাসন ব্যবস্থার
বিলুপ্তি ঘটিয়ে দেয়, পতন ঘটায় ইসলামিক
খেলাফতের।উসমানীয়দের পতন
সেই হিসেবে অটোম্যান রাজবংশের দ্বিতীয় আব্দ আল-মাজিদকেই বলা যায় এখন পর্যন্ত উসমানী সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান এবং মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ খলিফা। দীর্ঘ এ সময়কালে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়ের মাঝে দিয়ে গিয়েছে সাম্রাজ্যটি। ছয় শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত এ শাসনামলে মোট ছত্রিশজন সুলতান বসেছিলেন অটোম্যানদের নেতার আসনে। অবশেষে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশার নেতৃত্বে আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠা হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৬২৪ বছরের উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসন।
আরও পড়ুন: তুরস্কের দেশ পরিচিতি ও ইতিহাস
ভিডিও দেখুন:
0 মন্তব্যসমূহ