একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ। মিসরে তখন ফাতেমি সাম্রাজ্য ছড়াচ্ছে শিয়া মতবাদের বিষবাষ্প। নামে ফাতেমি হলেও এটি ছিল মূলত উবাইদিয়্যাহ সাম্রাজ্য। তারা ইসলামকে বিকৃত করছিল। প্রতিনিয়ত তাদের হাতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলেমরা হচ্ছিলেন নির্যাতিত। সে সময় পারস্যে মাথা তুলে দাঁড়ায় নতুন এক শক্তি। এরাও স্বপ্ন দেখছিল ফাতেমিদের মতো আরেকটি শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।
কিন্তু সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বেছে নেয় এক নতুন পথ। এর আগে যে পথ অবলম্বন করেনি আর কেউ। শুরুতে এরা পরিচিত ছিল ইসমাইলিয়্যাহ নামে। তবে পরে নানা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ক্রুসেডের সময় শামে এদেরকে বলা হতো হাশিশিয়্যাহ। ইংরেজিতে হাশিশিয়্যাহদের বলা হয় আ্যাসাসিন অর্থাত গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়। তবে এরা কুখ্যাতি পেয়েছে বাতেনিয়্যাহ নামেই।
মাত্র কয়েক বছরে এরা পুরো মুসলিম বিশ্বে নিজেদের প্রভাব ছড়িয়ে দেয়। ইসমাইলি ফিরকার এই দলের প্রতিষ্ঠাতা নিজেও এক রহস্যমানব। ইতিহাস যাকে চেনে হাসান বিন আলি আস-সাব্বাহ নামে। সংক্ষেপে হাসান বিন সাব্বাহ। আধুনিককালে প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর প্রাণপুরুষ বলা যায় তাকেই। তার আবিষ্কৃত নানা কূটকৌশল আজও অনুসরণ করছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।
হাসান বিন সাব্বাহর জন্ম ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তুস শহরে। তার পিতা সাব্বাহ ছিল একজন ইসমাইলী শিয়া পন্থি রাফেজি ফকিহ। হাসান বিন সাব্বাহর বাল্যকাল কাটে তুস শহরেই। হাসান সাব্বাহর ছেলে বেলাতেই তার পরিবার তুস শহর থেকে রে-শহরে চলে আসে। সে ছিল ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ছাত্রজীবনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা ও জাদুবিদ্যাতেও সে দক্ষতা অর্জন করে।
![]() |
ফাতেমী খেলাফত ম্যাপ |
এই সময় হাসান বিন সাব্বাহ ইসমাইলি
শিয়াদের অন্যতম ধর্মীয় গুরু আবদুল মালিক বিন আত্তাশের সান্নিধ্যলাভ করে। সে-সময়ে
ইসমাইলিদের মূল কেন্দ্র ছিল মিসরের ফাতেমি খেলাফত। ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে হাসান
সাব্বাহ রায় থেকে মিসরের উদ্দেশ্যে সফর করে। মিসরে সে ৮ মাস অবস্থান করে। এ সময় হাসান
সাব্বাহ ফাতেমী খলিফা মুস্তানসিরের সাথেও সাক্ষাত করে। খলিফা মুস্তানসির হাসানকে
শাহি প্রাসাদে মেহমান করে রাখেন এবং তাকে প্রচুর উপহার দেন। মিসরে অবস্থানকালে
হাসান ফাতেমিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । খলিফা মুস্তানসির
পারস্য ও খোরাসানে ইসমাইলিদের দাওয়াত প্রচার করার জন্য হাসানকে প্রেরণ করে।
১০৮৯ খ্রিস্টাব্দে হাসান সেলজুক
সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্ফাহানে পৌঁছে ইসমাইলি শিয়া ফিরকার দাওয়াত দিতে থাকে।
কিছুদিন পর সে চলে যায় কাজভিনে। এখানে সে আলামুত দুর্গ দখল করে নেয় এবং তার
অনুসারীদেরসহ সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। হাসান নিজেকে দাবি করত শিয়া ফাতেমী খলিফা
মুস্তানসিরের নায়েব বলে। একইসাথে সে পরিচিত হয়ে ওঠে শায়খুল জাবাল বা পর্বতের
বৃদ্ধা নামে।
আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাত
হাসান সাব্বাহ তার বাতেনী মতবাদের মাধ্যমে অশিক্ষিত মানুষদের গোমরাহীর পথে নিয়ে যেত। সে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা শুনিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ঠ করতো। তারা সালাত সহ ফরজ কাজসমূহকে অস্বীকার করতো। এবং ইমামের আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ হিসেবে বিশ্বাস করতো। তার প্রচারের মাধ্যমে হাসান সাব্বাহ অল্পদিনেই প্রচুর অনুসারী জুটিয়ে ফেলে।
একইসাথে গঠন করে তার প্রতি
নিবেদিতপ্রাণ ফেদায়ি বাহিনী। এ সময় আলামুতের আশপাশের কয়েকটি কেল্লাও সে দখল করে।
হাসান সাব্বাহর তৎপরতা সম্পর্কে সেলজুক সুলতান মালিক শাহ নিয়মিত সংবাদ পাচ্ছিলেন।
তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। এরপর সুলতান মালিক শাহ হাসানকে চূড়ান্ত পত্র দেন। পত্রের
ভাষ্য ছিল এমন–হাসান, তুমি এক নতুন দীনের সূচনা করেছ।
মানুষকে ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছ। একদল মূর্খকে একত্রিত করে পাহাড়ে বসে তাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছ। দীন ও মিল্লাতের প্রহরী আব্বাসি খলিফাদের বিরুদ্ধে মানুষকে উসকে দিচ্ছ। নিজেকে এবং নিজের অনুসারীদের ধবংসের মুখে ঠেলে দিও না। মনে রেখো, তোমার কেল্লা যদি আসমানের গম্বুজের উপরেও থাকে তাহলেও আমরা আল্লাহর সাহায্যে তা ধবংস করে ফেলবো।
![]() |
আলামুত দুর্গ |
সুলতানের পত্রের জবাবে হাসান একটি
দীর্ঘ পত্র লিখে জবাব দেয়। সেখানে সে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস স্পষ্ট করে এবং সে এই
বিশ্বাস থেকে যে ফিরে আসবে না তাও জানিয়ে দেয়। উপায় না দেখে সুলতান মালিক শাহ ১০৯০
খ্রিস্টাব্দে তার সেনাপতি আরসালানতাশের নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এই
বাহিনী এসে আলামুত দুর্গ অবরোধ করে। দুর্গ দুর্গম পাহাড়ের উপর থাকার ফলে সেলজুক
সেনাদের বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছিল। অবরোধ কয়েক মাস দীর্ঘ হয়।
কিন্তু চারমাস অবরোধ শেষেও হাসান
সাব্বাহকে পরাজিত করতে ব্যার্থ হয়ে আরসালান তাশ সেনাবাহিনী নিয়ে চলে ফিরে আসতে
বাধ্য হন। সালজুকি বাহিনী বিদায় নিলে হাসান বিন সাব্বাহ নতুন করে তার বাহিনীকে
ঢেলে সাজায়। ইতিমধ্যে নিজস্ব মতবাদ প্রচারের পাশাপাশি সে গড়ে তোলে ফেদায়ি বাহিনী।
সহজ ভাষায় বললে ভাড়াটে খুনী। এই বাহিনীর কর্মীরা ছিল হাসানের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।
হাসানের ইশারায় তারা মৃত্যুর জন্য
প্রস্তুত ছিল। এরা টাকার বিনিময়ে হত্যা করতো। আবার হাসান বিন সাব্বাহর আদেশ পেলে
কারণ ছাড়াই যে-কাউকে হত্যা করে ফেলতো। এমনকি হাসানের আদেশ পেলে নিজেকে হত্যা করতেও
দ্বিধা করতো না। এরা সাধারণত তারা নামাজ চলাকালীন হামলা চালাতো। অল্পদিনেই তারা
মুসলিম বিশ্বে ত্রাসের সঞ্চার করে। এরাই পরবর্তীতে আ্যাসাসিন বা গুপ্তঘাতক
সম্প্রদায় নামে আত্মপ্রকাশক করে। এরা নিজের ধর্মবিশ্বাস গোপন রাখতো তাই তাদেরকে
বাতেনিও বলা হতো।
আরও পড়ুন: সুলতান মালিক শাহের পর সেলজুক সাম্রাজ্যেল অবস্থা কেমন হয়েছিল?
হাসান বিন সাব্বাহ পারস্যে অনেক দুর্গ দখল করে। এসব দুর্গের আশপাশে তারা প্রচুর লুটপাট করতো। এসব দুর্গ দুর্গম স্থানে অবস্থিত হওয়ার কারণে সেলজুক সেনাবাহিনীও হাসানের বিরুদ্ধে তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। হাসান সাব্বাহ ছিল খুবই প্রতিভাধর এক অপরাধী। সে ষড়যন্ত্র ও প্রতারণায় কুখ্যাত ছিল।
![]() |
নিজামুল মুলক |
আরও পড়ুন: নিজামুল মুলকের জীবনী
বরং তারা সিরিয়ায় বেশকিছু কেল্লা দখল করে একটি রাজ্য গঠন করে। পারস্যের বাতেনীদের উপর প্রাথম কার্যকর হামলা করেছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারেজম শাহ। তিনি তাদের অনেকগুলো কেল্লা গুড়িয়ে দেন। ক্রুসেডের সময় সিরিয়ার বাতেনিরা ক্রুসেডারদের সাথে হাত মেলায়। তখনকার হাসান সাব্বাহর অনুসারী শায়খুল জাবাল রশিদুদ্দিন সিনান সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির উপর হামলা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালেও তারা ব্যর্থ হয়।
![]() |
হালাখু খানের আক্রমণ |
এরপর ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খান
আলামুতে হামলা করে বাতেনীদের নেতা রুকনুদ্দিন খোরশাহকে পরাজিত করে এবং বাতেনিদের
স্বপ্নের দুর্গ চিরতরে ধবংস করে দেয়। সিরিয়ার বাতেনিদের উপর চূড়ান্ত আঘাত করেছিলেন
মামলুক সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স। তাঁর আক্রমণে তাদের সিরিয়ার ঘাটি ধবংস হয়।
বেশিরভাগ বাতেনি নিহত হয়। এভাবে পরিসমাপ্তী ঘটে কুখ্যাত বাতেনী সম্প্রদায় এবং
গুপ্তঘাতক দলের।
আরও পড়ুন:সুলতান আহমেদ সানজার
0 মন্তব্যসমূহ