৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (স) মক্কার কুরাইশদের হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন একদম খালী হাতে। এর মাত্র ৮ বছর পর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (স) ১০ হাজার সাহাবী নিয়ে যখন মক্কা বিজয় করেন, তখিন ছিলেন আরবের এক মহান রাষ্ট্রপ্রধান, একজন বীর সেনাপতি এবং সফল ধর্মপ্রচারক।
মহানবী (স) যেভাবে অল্পদিনের মধ্যেই ইসলামকে আরব তথা পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি ভাবে আর কোন নবী-রাসূলের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মহানবীর (স) ৪০ বছর বয়সে তিনি যখন ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তখন প্রকাশ্যে বা গোপনে হাতে গুনা কয়েকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এমনকি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরতের সময়ও মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েকজন।
কিন্তু মহানবী (স) কতৃক ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরবের বুকে ইসলামের পুনুরুত্থান হয়। একজন ন্যায় বিচারক, সুশাসক এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আরবের লোকেরা মহানবী (স) কে ধীরে ধীরে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে।
এরপর ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধে মক্কার কাফেরদের পরাজয়, ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধে আরব বেদুইন-ইহুদিদের সম্মীলিত বাহিনীর পরাজয় সর্বপরি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (স) এর নেতৃত্বে মুসলমানরা আরবে পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তাছাড়া এই সময় থেকে আরবে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা আরবের লোকেরা বুঝতে পেরেছিল মহানবী (স) সত্য, ইসলাম সত্য। সুতরাং এই সত্য গ্রহণ করে জীবন পরিচালনা করলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সর্বোত্তম আসন লাভ করবে।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হুনায়ন ও তায়েফ বিজয় এবং ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে তাবুক বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিরা আগমন করে। তাদের অধিকাংশ মহানবী (স) নিকট ইসলাম গ্রহণ করে আর অন্যরা মদিনা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে।
এভাবে বিভিন্ন গোত্রের নিকট থেকে মদিনায় দলে দলে প্রতনিধিরা আসতে শুরু করলে মহানবী (স) বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার জীবনের মহান কর্তব্য শেষ হয়েছে এবং তার জীবন প্রদীপ শেষ হয়ে আসছে। তাই হাজ্জ্বাতুল বিদা তথা বিদায় হ্জ্জব পালনের উদ্দেশ্যে মহানবী (স) ২৫ জিলহজ্জ্ব ১০ হিজরি মোতাবেক ২৩ ফেব্রুয়ারি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ সাহাবী নিয়ে মদিনা থেকে মক্কার পথে যাত্রা শরু করেন।
যাত্রার দশ দিন পর মক্কার ছয় মাইল দূরে জুল হুলায়ফা নামক স্থানে তিনি সাহাবীদের নিয়ে হজ্জ্বের পোশাক পরিধান করেন এবং একাদশ দিনে মক্কায় প্রবেশ করেন। এরপর মহানবী (স) হজ্জ্ব সম্পাদন করে আরাফাতের পর্বতের শিখরে আরোহণ করে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনতার উদ্দেশ্যে একটি অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন। তার এ শেষ উপদশে বাণীকে বিদায়ী ভাষণ বলা হয়,যা মুসলমানদের জন্য ইহকাল ও পরাকালের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।
অনেক ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষনকে ইতিহাসের প্রধান মানবাধিকার সনদ বলে মন্তব্য করেন। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমবেত জনমুদ্রের উদ্দেশ্যে বললেন, ``
*হে আমার প্রিয় ভক্তবৃন্দ, আমার কথা গুলো তোমরা মনোযোগ দিয়ে
শোন, কারণ আগামী বছর এই সময়ে আমি তোমাদের মাঝে সমবেত হতে পারব কিনা জানি না।
*তোমাদের পরস্পরের জীবন ও ধন-সম্পদ পরস্পরের কাছে শেষ দিন
পরযন্ত আজকের মত পবিত্র বলে মনে করিও।
*হে মানবমন্ডলী, তোমাদের হক যেমন তোমাদের স্ত্রীর উপর রয়েছে, তাদেরও হক রয়েছে তোমাদের উপর। তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যব্যবহার করিও। নিশ্চয় তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের আল্লাহকে সাক্ষী করে গ্রহণ করেছ এবং তোমাদের জন্য তাদেরকে আইনসঙ্গত করা হয়েছে।
*সর্বদা অন্যের আমানতের হেফাজত করবে এবং গুনাহ হতে বিরত থাকবে।
*সুদ হারাম, শুধু আসলেই ফেরত দিবে, তার বেশি নয়।
*এখন হতে জাহিলিয়া আমলের রক্তের বদলে রক্ত নীতি বর্জিত হলো
এবং হত্যা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ হলো।
*তোমাদের ভৃত্তদের সাথে তোমরা স্বদ্যব্যবহার করিও। তুমি যা আহার করবে, তা তাদেরকেও আহার করাবে, যা পরিধান করো , তা তাদেরকেও পরিধান করাবে। যদি তারা কোন অপরাধ করে, যা তুমি অমার্জনীয় বলে মনে কর, তাহলে তাদেরকে বিদায় দাও। কারন তারাও আল্লাহর বান্দা এবং সেই হিসেবে তাদের সঙ্গে নির্দয় ব্যবহার করা উচিত নয়।
*হে সমবেত মুসলিমগণ, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো ও উপলদ্ধি করো। জেনে রাখ , সকল মুসলিম ভাই ভাই। তোমরা সকলে ভাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। এক ভাইয়ের সম্পদ অন্য ভাইয়ের জন্য হারাম, যতক্ষণ না সে সেচ্ছ্বায় তা না দেয়। অন্যায় অবিচার হতে দূরে থাকো।
*তোমাদের হেদায়েতরে জন্য আল্লাহর কোরআন এবং আমার সুন্নাহ
রেখে গেলাম- এই দুইটি শক্ত করে আকড়ে ধর, তাহলে তোমাদের কোন ভয় ভাবনা থাকবে না।
*মনে রেখ, বাসভূমি ও বর্ণ নির্বশেষে প্রত্যেক মুসলিম সম পরযায়ভুক্ত। আজ থেকে বংশগত কৌলিন্য প্রতা বিলুপ্ত হলো। সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় কাজের বৈশিষ্ট ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আগ্রহী।
*হে আমার উম্মতগণ! যারা এখানে উপস্থিত আছ, তারা অনুপস্থিত মুসলিমদের নিকট আমার উপদেশ পৌছে দিবে। যারা অনুপস্থিত তাদেরকে আমার উপদেশের কথা বলবে। উপস্থিত ব্যক্তিগণ অপেক্ষা তারাই অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে।
*হযরত মুহাম্মদ (স) অভিভাষণ প্রচারের পর উর্ধে হাত তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন, হে প্রভু, আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জগণের নিকট পৌছাতে পেরেছি? উপস্থিত জনতা গগণভেদী আওয়াজ ভরে বলে উঠল, হ্যা নিশ্চয় পেরেছেন।
*এমন সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হলো, হে মুহাম্মদ, আজ আমি তোমার ধর্মকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমার উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমার ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। সরা মায়েদা-আয়াত, ৩।
অবশেষে হযরত মুহাম্মদ (স) আবেগভরা কণ্ঠে সমবেত ভক্তকুলকে
লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা সাক্ষী, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।
তথ্যের উৎস সমূহ:
লেখক : আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী
অনুবাদ : খাদিজা আখতার রেজায়ী।
১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান
0 মন্তব্যসমূহ