রোমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস |

                     আরও পড়ুন: উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস

মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের নাম মনে করলে প্রথমদিকেই আমাদের মনে আসে সেলজুকদের কথা। তারা ছিল ওগুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত সেলজুক রাজবংশের শাসক। এই সেলজুকদের একটি বিশেষ শাখা ছিল রুমের সেলজুকীয়রা। তারা একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত আনাতোলিয়ায় রুমের সেলজুক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। বর্তমানে যে অঞ্চল তুরস্ক নামে পরিচিত, সেসময় তাকে লোকে আনাতোলিয়া বা রুম নামেই জানত। আবার আনাতোলিয়াকে ইংরেজিতে এশিয়া মাইনর  বলে অভিহিত করা হয়।

পূর্ব রোমান তথা বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ হওয়ায় এ অঞ্চলকে রুম বলে অভিহিত করা হয়।প্রথমে সালতানাতের রাজধানী ছিল ইজনিক এবং পরবর্তিতে কোনিয়াতে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয়। ঐতিহাসিকরা রুমের সেলজুক সালতানাতকে কোনিয়া সালতানাতও বলে চিহ্নিত করে। সমৃদ্ধির শীর্ষে থাকা অবস্থায় রুমের সেলজুক সালতানাত ভূমধ্যসাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত মধ্য আনাতোলিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বায়জান্টাইন, খাওয়ারিজমি এবং আয়ুবিদ সাম্রোজ্যের অনেক অঞ্চল রুম সালতানাত কর্তৃক বিজিত হয়।       

                                                                         

১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মানজিকার্টের যুদ্ধে সেলজুক সুলতান আল্প আরসালান মাত্র ৪০ হাজার মুসলিম বীর সেনানী নিয়ে দুই লক্ষাধিক খ্রিস্টান বাইজান্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে বিজয়ের ফলে বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিনে থাকা অঞ্চল আনাতোলিয়া তথা এশিয়া মাইনরে সেলজুক সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। সুলতার আলপ আরসালান রাজ্য জয়ের পর এশিয়া মাইনরের শাসনভার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে তার চাচা কুলতিমিশের পুত্র সুলায়মানকে প্রদান করেন।

বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসনকর্তা সুলায়মান তার রাজ্যসীমা উত্তরে কৃষ্ণসাগর ও পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর‌্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং বায়জান্টাইন সম্রাটকে কর দানে বাধ্য করেন। ১০৭৫ সালে তিনি বাইজেন্টাইন শহর নিকাইয়া এবং নিকোমেডিয়া দখল করেছিলেন। ১০৭৭ সুলাইমান সেলজুক সাম্রাজ্যের সাথে বিদ্রোহ করে, নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন এবং আনাতোলিয়ায় রুমের সেলজুক সালতানাতের গোড়াপত্তন করেন। এরপর তিনি ইজানিকে সালতানাতের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন।                

রুম সালতানাত

আরও পড়ুন: মানজিকার্টের যুদ্ধের ইতিহাস

কিন্তু ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা ইজনিক দখল করলে তিনি আনাতোলিয়ার কোনিয়ায় তার রাজধানী স্থাপন করেন। সুলায়মান যখন নিজেকে রুম সালতানাতের স্বাধীন ‍সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন মালিক শাহ। অত:পর সুলতান মালিকশাহ ১০৮৬ সালে তার ভাই ও সিরিয়ার সেলজুক শাসক, মেলিক তুতুশের নেতৃত্বে সুলাইমানের বিরোদ্ধে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন।   

যুদ্ধে সুলাইমান মেলিক তুতুসের হাতে পরাজিত ও নিহত হন এবং সুলাইমানের পুত্র কিলিজ আরসলানকেও বন্দী করা হয়। সুলতান মালিক শাহ ১০৯২ সালে মৃত্যুবরণ করলে কিলিজ আরসলানকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত রুম সালতানাতের সিংহাসানে আরোহণ করেন।                 

অন্যদিকে সুলতান মালিক শাহের মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠত্ব ও ঐক্য বিলুপ্ত হতে থাকে।মালিক শাহের পরবর্তী শাসকরা ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ফলে সেলজুক সাম্রাজ্য পতনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। সেলজুকদের দুর্বলতার সুযোগে রুম সালতানাত শক্তি সঞ্চয় করে। সুলতান কিলিজ আরসালানের নেতৃত্বে রুমের সেলজুকরা বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চল বিজয় করে।

তিনি ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া প্রথম ক্রুসেডের যুদ্ধে আনাতোলিয়ায় তিনিটি ক্রুসেডার বাহিনীকে পরাজিত করে। সুলতান কিলিজ আরসালান ছিলেন ক্রুসেডারদের বিরোদ্ধে যুদ্ধ করা প্রথম মুসলিম সেনাপতি। ১১০৯ খ্রিস্টাব্দে এক যুদ্ধে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ১১০৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কিলিজ আরসালানের মৃত্যুর পর ১২২০ খ্রিস্টাব্দ পরযন্ত ৮ সুলতান রুম সালতানাত শাসন করে।             


 
১২২০ খ্রিস্টাব্দে রোম সালতানাতের সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদ। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রুমীয় সেলজুক সুলতান। তিনি মোঙ্গলদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীন বায়জান্টাইন, খাওয়ারিজম এবং আয়ুবিদ সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চল নিজের সালাতানভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার শাসনকাল ছিল রুম সালতানাদের স্বর্ণযুগ।

আরও পড়ুন: সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান                 

সুলতান আলাউদ্দীনের সেনাপতিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন আর্তগ্রুল গাজী, যিনি ছিলেন উসমানীয় সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান ওসমান গাজীর পিতা। আর্তুগুল গাজী সুলতান আলাউদ্দীনের অধিনে বায়জান্টাইনদের অনেক অঞ্চল বিজয় করেন। সুলতান আলাউদ্দীন আর্তগ্রুল গাজীকে সগুতের শাসনভার অর্পণ করেন। এবং এই সগুতকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে উসমানীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়।

১২৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‍সুলতান আলাউদ্দীনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় কাইখসরু রুম সালতানাতের সুলতান হন।কাইখসরুর শাসনকালে রোমের সালতানাত অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও দ্বন্দের ফলে দুর্বল হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গোলরা আনাতোলিয়ায় আক্রমণ করে। মঙ্গোল বাহিনী ১২৪২ সালে এরজুরুম শহর দখল করে এবং ১২৪৩ সালে সুলতান কাইখসরু কোসেদাগ যুদ্ধে দুর্দর্ষ মোঙ্গল কমান্ডার বাইজু নয়ানের কাছে পরাজিত হয়।                             

পরাজিত হওয়ার পর সেলজুক তুর্কিরা মঙ্গোলদের প্রতি আনুগত্যের শপথ করতে বাধ্য হয় এবং তাদের অনুগত হয়ে ওঠে। সুলতান নিজেও ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধের পরে বায়জান্টাইন শহর আন্তালিয়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানে তিনি ১২৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

সুলতান কাইখসরুর মৃত্যুর পর রোমের সেলজুক সালতানাত তার তিন ছেলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুলতানের জ্যৈষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় কায়কাউস সালতানাতের এক অংশে স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। অন্যদিকে তাঁর অপর দুই পুত্র ৪র্থ কিলিজ আরসলান  এবং দ্বিতীয় কায়কোবাদ মঙ্গোলদের অধীনে  কোনিয়া কেন্দ্রীক সালাতানাতের অপর অংশে শাসন পরিচালনা করেন।   

কোনিয়া ম্যাপ

১২৫৬ সালের অক্টোবরে মোঙ্গল সেনাপতি বাইজু নয়ান আকসারায়ের নিকটে সুলতান দ্বিতীয় কায়কাউসকে পরাজিত করেন এবং এর মাধ্যমে সমগ্র আনাতোলিয়া মোঙ্গলদের অধীনস্ত হয়ে পড়ে। ১২৬০ সালে দ্বিতীয় কায়কাউস কায়ী বসতির প্রধান আর্তুগুল বের সহায়তায় কোনিয়া থেকে ক্রিমিয়াতে পালিয়ে যান। এবং তিনি ১২৭৯ সালে ক্রিমিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন।               

       আরও পড়ুন: সুলতান মালিক শাহের ইতিহাস                     

এরপর মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য চতুর্থ কিলিজ আরসলানকে ১২৬৫ সালে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। অতপর তৃতীয় কায়খসরুকে মঙ্গোলদের অধিনস্ত সমগ্র আনাতোলিয়ার নামমাত্র শাসক হিসেবে অধিস্টিত করা হয়। রুমের সেলজুক সালতানাত মোঙ্গলদের পদানত হওয়ার পর,সালতানাতটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেইলিক তথা আমিরাতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

মোঙ্গলদের অধিনস্ত সুলতান তৃতীয় কাইখসরুর শাসনামলের শেষের দিকে কোনিয়া ব্যাতিত বাকি সমগ্র রোম সালতানাতের অঞ্চল সমূহ বেইলিক এবং সেলজুক আমিরদের দ্বারা স্বাধীনভাবে শাসিত হতে থাকে। বেইলিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল কারামান এবং ওসমানী বেইলিক। এইসব বেইলিক গুলো স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করলেও, তারা সুলতানদের নামে খুতবা প্রদান করতেন এবং সুলতানকে স্বীকৃতি দিতেন।

১২৮৪ মোঙ্গলদের সাথে দ্বন্দ দেখা দিলে মোঙ্গলরা সুলতান তৃতীয় কাইখসরোকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মাসুদ কোনিয়ার নতুন সুলতান হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য ১৩০৮ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাসুদকেও হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় মাসুদের পর তার পুত্র তৃতীয় মাসুদকেও মোঙ্গলরা হত্যা করে। এভাবে মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় রোমের সেলজুক সালতানাত। মূলত সুলতান দ্বিতীয় মাসুদের মৃত্যুর মাধ্যমে রোমের সেলজুক সালতানাতের পতন ঘটে।     

রোম সালতানাতের পতনের পর সমগ্র অঞ্চল বিভিন্ন বেইলিক এবং আমিরাতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া মঙ্গোল রাজ্য ইলখানাতের শাসক গাজান খান ইসলাম গ্রহণ করলে তুর্কি বেইলিক এবং আমিরাতগুলোতে মঙ্গোল ভীতি চলে যায়। প্রথম দিকে কোনিয়া সহ অধিকাংশ সেলজুক অঞ্চল কারামানি রাজবংশ দখল করলেও, পরবর্তীতে এই সব অঞ্চল উসমানীয় রাজবংশের অধিনে চলে আসে। এবং আনাতোলিয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠীত হয় তিন মহাদেশ বেষ্টিত উসমানীয় সালতানাতের।

আরও পড়ুন: তুরস্ক : দেশ পরিচিতি ও ইতিহাস

           ভিডিও দেখুন:

                                                                             


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ