ইতিহাস বিজয়ী আর বিজয়কে উন্মোচিত করে, পরাজয় আর পরাজিতকে ঢেকে রাখে বিস্মৃতির আড়ালে; কিন্তু কোনো কোনো পরাজয় ও পরাজিত পক্ষ এতই মহিয়ান হয়, তা গৌরবের দিক দিয়ে অনেক বিজয়কে ছাড়িয়ে যায়—দূর বহু দূর। ইতিহাসের তেমনই পরাজিত এক মহানায়ক সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ। জালালুদ্দিন ছিলেন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান। তিনিই মঙ্গদের প্রথম প্রতিরোধকারী।
১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাগদাদের
আব্বাসীয় খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে অসংখ্য সালতানাত ও সাম্রাজ্যের আবির্ভাব হয়। এদের
মধ্যে সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ছিল তুর্কি সেলজুক সাম্রাজ্য, এই সাম্রাজ্যের
ধ্বংস্তূপে প্রতিষ্ঠিত হয় আরও এক তুর্কি সাম্রাজ্য, খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দে
কুতুব উদ্দীন মুহাম্মদের হাত ধরে সমরকন্দকে রাজধানী করে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সাম্রাজ্যটি।
খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড়শত বছর পরের কথা, সাম্রাজ্যের শাসক তখন সুলতান
আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ।
১২২৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে লুটেরা
গোত্রগুলোকে একত্র করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করলেন চেঙ্গিস
খান। দুর্ধর্ষ ও বর্বর এই মঙ্গোলরা তখন মধ্য এশিয়ার অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। দীগ্দজয়ী
বাসনা এবং আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি চেঙ্গিস
খানের। বিশাল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
চেঙ্গিস খান তার মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে বর্বরতা চালিয়ে একের পর এক খাওয়ারিজম
সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ শহরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে থাকে।
সুলতান আলাউদ্দীন খাওয়ারিজম শাহ
সুলতান আলাউদ্দিন মঙ্গোল-আতঙ্ক
থেকে বাচতে বছরের পর বছর ধরে মঙ্গোলদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু
শেষপর্যন্ত তার মৃত্যু হয় পলাতক অবস্থায়, কাস্পিয়ান সাগরের এক নির্জন দ্বীপে। মৃত্যুর আগে পুত্র জালাল উদ্দীনকে তিনি
সুলতান ঘোষণা করে যান। ক্ষমতা গ্রহণ করেই জালালুদ্দিন স্রোতের বিরুদ্ধে মুসলিম
বিশ্বকে ঐক্যের আহ্বান জানান, সেনা সংগ্রহ শুরু করে দেন। তিনি তার পিতার মতো ভীতু
ছিলেন না।
কিন্তু কিছুদিন
শাসনকার্য পরিচালনা করার পর তার ভাই রোকনুদ্দিন ক্ষমতার জন্য বিদ্রোহ করেন।
জালালুদ্দিন ভাইয়ের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আফগানিস্তানের পথ ধরলেন। চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে মুসলিমদের এক করতে থাকেন।
বিভিন্ন
শহর ঘুরে তিনি সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। কিন্তু প্রাণান্ত চেষ্টা করেও সুলতান তখন
পর্যন্ত কয়েক হাজারের বেশি সৈন্য সংগ্রহ করতে পারেননি।
এ
খবর পৌঁছে যায় চেঙ্গিস খানের কাছে। এ সময় সুলতান আমু দরিয়ার পাড় ধরে
সিস্তান, বলখ এবং কান্দাহার অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। মঙ্গোলদের একটি দল কান্দাহার অবরোধ
করলে সুলতানের বাহিনী নিঃশব্দ চিতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর। অতর্কিত হামলায়
দিশেহারা হয়ে মঙ্গোলরা পালাতে থাকে। পালানোর রাস্তাতেও সুলতানের বাহিনী মোতায়েন
করা ছিল। এ যুদ্ধে প্রায় সকল মঙ্গোল সেনা নিহত হয়। এটাই ছিল মুসলমানদের হাতে
মঙ্গোলদের প্রথম পরাজয়।
এদিকে কান্দাহারের
পরাজয়ের কথা কানে গেলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন চেঙ্গিস খান। সময় নষ্ট না করে
তিনি বিশাল এক মঙ্গোল বাহিনীকে পাঠান গজনীর অভিমুখে। সুলতান জালালুদ্দিন সংবাদ
পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি
অবলম্বন করলেন এক ভিন্ন পদ্ধতি। প্রত্যেকবার মঙ্গোলরা আক্রমণ করেছে, আর সুলতান
প্রতিরোধ করেছেন। কিন্তু সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তারা মঙ্গোলদের উপর প্রথম
অতর্কিত হামলা চালাবেন। সুলতান তার বাহিনী নিয়ে গজনি থেকে বের হয়ে 'বলক' নামক
স্থানে মঙ্গোলদের মুখোমুখি হলেন।
মঙ্গোলদের
সৈন্যসংখ্যা ছিল সুলতানের সেনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।সুলতানের
বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে মঙ্গোলরা এবার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগল। খুব
অল্প সংখ্যক মঙ্গোল সৈন্যই কচুকাটা হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিল। এ
যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সুলতান প্রমাণ করলেন, মঙ্গোলরা অপরাজেয় নয়। বিজয় সংবাদ
মুসলিম বিশ্বের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে গেল। এভাবে কয়েকটি যুদ্ধে সুলতান
জালালুদ্দিনের কাছে নাস্তানাবুদ হলো মঙ্গোলরা।চেঙ্গিস খান
চেঙ্গিস
খান ক্রমশই আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন সুলতান জালালুদ্দিনের ব্যাপারে। মাত্র ২৫ বছরের এক
যুবকের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে 'অপরাজেয়' চেঙ্গিস বাহিনী।
খোদ চেঙ্গিস খান
এবার তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগিয়ে এলেন জালালুদ্দিনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
সুলতান জালালুদ্দিনকে দেখে চেঙ্গিস খান ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। তাই তিনি নিজে যুদ্ধের
ময়দানে আসলেন না, দায়িত্ব দিলেন তার পুত্র তোলি খানকে। নিজে অবস্থান নিলেন
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু দূরে।
১২২১ সালের কোনো এক বসন্তে, পারওয়ানের ময়দানে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। অস্ত্রের ঝঙ্কারে পুরো ময়দান মুখরিত হয়ে উঠল। প্রথম দিন যুদ্ধে মঙ্গোলরা সুবিধা করতে পারল না। রাতে তারা একটি আশ্চর্য ফন্দি আঁটল। নিহত সেনাদের লাশ ময়দানের একটু দূরে নিয়ে গেল, তারপর লাঠি পুঁতে লাঠির সঙ্গে এই লাশগুলো বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখল। এমন হাজার হাজার লাশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ফলে দূর থেকে মনে হচ্ছিল, এখানে অনেক সেনা দাঁড়িয়ে আছে।
সুলতান জালালুদ্দিন ভেবে বসলেন, হয়তো বড় কোনো বাহিনী এসে মঙ্গোলদের সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেন না। পরদিন যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুলতানের অনন্য যুদ্ধকৌশল, আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তার কাছে সেদিন পরাজিত হলো মঙ্গোলরা। এ যুদ্ধে প্রচুর মঙ্গোল সেনা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। নিহত হন মঙ্গোল বাহিনীর সেনাপতি ও চেঙ্গিস খানের পুত্র তোলি খানও।
চেঙ্গিস খান যখন
চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন গনিমতের মাল ভাগাভাগি করা নিয়ে
সুলতানের বাহিনী দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এদিকে
পুরো মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে বিধ্বংসী রূপে এগিয়ে আসছেন চেঙ্গিস খান। অন্যদিকে
মুসলিম শিবিরে বিভক্তি আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সময় পার হচ্ছে। সুলতান জালালুদ্দিন
তার বাহিনী নিয়ে গজনি ত্যাগ করলেন। অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও সুলতান তীব্র বেগে
ছুটতে থাকলেন সিন্ধু অভিমুখে। সুলতানের মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যকে ধাওয়া করতে
লাগল কয়েক লক্ষ সৈন্যের বিশাল মঙ্গোল ঝড়।
সুলতান চেয়েছিলেন,
সিন্ধু নদ অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করবেন। সেখান থেকে দিল্লির শাসক
শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সাহায্যে সেনাবাহিনীর গঠন করে পুনরায় আফগানিস্তানে ফিরে এসে
মঙ্গোলদের সঙ্গে লড়বেন। এদিকে চেঙ্গিস খান বুঝতে পারলেন, সুলতান জালালুদ্দিন যদি
কোনোভাবে সিন্ধু অতিক্রম করেন, তাহলে আর তাকে আটকানো সম্ভব হবে না। তাই তিনি
চাচ্ছিলেন, যেকোনো উপায়ে সিন্ধু নদ পার হওয়ার আগেই জালালুদ্দিনকে হত্যা করতে
হবে।
২৪ নভেম্বর, ১২২১ সাল।
সিন্ধু নদীর পাড়ে নিলাব নামক স্থানে সুলতান জালালুদ্দিন পড়লেন মহাসংকটে। মঙ্গোল
বাহিনী অতি নিকটে চলে এসেছে, পেছনে খরস্রোতা সিন্ধু নদ প্রবহমান। সৈন্যদের
পারাপারের জন্য কোনো বাহন নেই। এখানে দাঁড়িয়ে সুলতান জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম
সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিকে তিনি জীবন বাজি রেখে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন,
অন্যদিকে পরিবারের নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। পরিবারের নারীদের
চেঙ্গিস খানের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে খরস্রোতা সিন্ধুর বুকে ভাসিয়ে দেন তিনি। সুলতান জালালউদ্দীন
শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। কয়েক লক্ষ দুর্ধর্ষ মঙ্গোল যোদ্ধার মোকাবেলা করা সুলতানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর অবস্থানের ফলে বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এলো। অধিকাংশ মুসলিম সৈন্য নিহত হলো। সুলতানের সাথে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন যোদ্ধা লড়তে থাকে মঙ্গোল বাহিনীর বিপক্ষে। চেঙ্গিস খান তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন সুলতানকে পরাজিত করতে।
সুলতান জালালউদ্দীন যখন দেখলেন,
কোনোভাবেই আর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, তখন তিনি মঙ্গোলদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে
উঠে গেলেন এক টিলায়। টিলার ডানপাশে বইছে উত্তাল সিন্ধু নদ। প্রায় ১৮০ ফুট উচ্চতা
থেকে তিনি আচমকা ঘোড়াসহ ঝাঁপ দিলেন উত্তাল সিন্ধুর বুকে। মঙ্গোলরা বিস্ময় চোখে
তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা ভাবতেও পারেনি সুলতান হুট করে এমন কাজ করে বসবেন।
সাঁতরে তিনি পার হয়ে এলেন নদীর এপারে। ওপারে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল চেঙ্গিস
খান ও তার কয়েক লক্ষ সৈন্য।
সুলতান জালালুদ্দিন
তার সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন মঙ্গোলদের রুখতে। মঙ্গোল বাহিনী এবং মুসলমানদের মধ্যে
তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন জুলকারনাইনের প্রাচীর হিসেবে। তার প্রতিরোধের মুখে
চেঙ্গিস খান থেমে যান খোরাসানের মাটিতে। এছাড়া সুলতানকে লড়াই করতে হয়েছিল
আব্বাসীয় খিলাফত এবং জর্জিয়ায় ক্রুসেডের বিরুদ্ধেও। পুরোটা জীবন নৃশংস মঙ্গোলদের
বিরুদ্ধে লড়াই করে ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট, সুলতান জালালুদ্দিন এক আততাতীর
হাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর। তার মৃত্যুর
সাথে সাথে একদিকে পতন ঘটে শক্তিশালী খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের, অন্যদিকে মুসলিম
বিশ্বে নেমে আসে ভয়াবহ ঘুর অমানীষা।
যদিও মুসলিম বিশ্ব
তখন জালালুদ্দিনের এই অবদানকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সুলতান জালালউদ্দীনের মৃত্যুর কয়েক
বছর পরই যখন নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে মঙ্গোলরা। যখন আর তাদেরকে প্রতিরোধ
করার কেউ নেই। ১২৫৮ সালে হালাকু খানের আক্রমণে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটল বাগদাদের।
পৈশাচিক গণহত্যার শিকার হলো ১৬ লক্ষ মুসলিম। পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী পরিণত
হলো ধ্বংসস্তূপে। এভাবেই একের পর এক পতন হতে থাকলো মুসলিম শহরগুলোর। তখন মুসলিম
বিশ্ব সুলতান জালাল উদ্দীনের অভাব বুঝতে থাকে। এখনো মুসলিম বিশ্ব সুলতান জালাল
উদ্দীনের মত বীরদের খুজে ফিরে, যার সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বের আশ্রয়ে পথভ্রষ্ট
মুসলিম জাতী খুজে পাবে মুক্তির দীশা।
0 মন্তব্যসমূহ