মক্কা বিজয় : রক্তপাতহীন এক মহাবিজয়।

 

                                               ভিডিও দেখুন (প্রথম পর্ব)


          পূর্বের অংশ পড়ুন : মুতার যুদ্ধ : প্রথম মুসলিম-খ্রিস্টান সংঘর্ষ।

মক্কা অভিযানের কারণ : ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ এবং মুসলমানদের মাঝে সাক্ষরিত হওয়া, হোদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারায় বলা হয়েছিল, যে কেউ ইচ্ছা করলে মহানবী (স) অথবা কোরায়শদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে। যিনি যে দলে যুক্ত হবেন, তিনি সেই দলের অংশ বলেই বিবেচিত হবেন। কেউ যদি হামলা বা অন্য কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করে, তা সেই দলের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে।

এই চুক্তির মাধ্যমে বনু খোজাআ গোত্র, ইসলাম গ্রহণ করে মহানবী (স) এর সাথে, মিত্রতার বন্ধনে আবন্ধ হয়েছিলেন। অন্যদিকে বকর গোত্র আবদ্ধ হয়েছিলো, কোরায়শদের মিত্রতার বন্ধনে। এমনি করে উভয় গোত্র, পরস্পর থেকে নিরাপদ হয়েছিলো। কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় থেকেই, উভয় গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে, বিবাদ বিসংবাদ চলে আসছিলো। পরবর্তিকালে আরবে ইসলামের পূন-আবির্ভাব এবং হোদায়বিয়ার সন্ধির পর, বিবদমান উভয় গোত্র পরস্পরের ব্যাপারে নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো।

কিন্তু কুরাইশদের মিত্র বনু বকর গোত্র, এই চুক্তি ভঙ্গ করে মহানবী (স) এর মিত্র, বনু খোযাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়। আকস্মিক হামলায় বনু খোযাআ গোত্রের, কয়েকজন লোক মারা যায়। এমনকি কোরায়শরা এই হামলায়, বনু বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কোরায়শদের কিছু লোক, রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে, বনু বকর গোত্রের সাথে মিশে গিয়ে, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাও করে।

এই হামরার পর, বুদাইল ইবনে ওরাকা খোযায়ীর নেতৃত্বে, বনু খোযাআ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল, মদীনায় এসে মহানবী (স) কে, বনু বকরের হামলার কথা অভিহিত করেন। তারা বনু বকর গোত্রকে, কুরাইশদের সাহায্যের কথাও মহানবী (স) কে জানায়। কোরায়শ এবং তার মিত্ররা যা করেছিলো, সেটা ছিলো হোদায়বিয়ায় সন্ধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এর কোন বৈধতার অজুহাত দেখানো যাবে না। এর ফলে বড় ধরনের যুদ্ধও সংঘটিত হতে পারে।

অপরদিকে মহানবী (স) কুরাইশদের বিপক্ষে, সরাসরি যুদ্ধাভিযান না পাঠিয়ে, কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে তাদের কাছে দূত প্রেরণ করেন- প্রস্তাব কয়েকটি ছিল: ১.তোমরা হয় বনি খোজা গোত্রকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে এ অন্যায়ের প্রতিকার কর।

২.অথবা বনি বকর গোত্রের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন কর।

৩.অথবা হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়েছে বলে ঘোষণা কর।

মহানবী (স) এর পত্র পেয়ে কোরাইশগণ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। অপরপক্ষে প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত দুটি মেনে নেওয়া ছিল নিতান্তই অপমানজনক। তাই তারা নিরুপায় হয়ে, তৃতীয় প্রস্তাব মেনে নেয়। দশ বছরের জন্য এই চুক্তি করা হলেও, মাত্র দুই বছরেই চুক্তিটি এভাবে লঙ্গিত হয়ে যায়। দূত মদীনায় ফিরে এসে, কুরাইশদের কর্মকান্ড মহানবী (স) কে বিস্তারিত বললেন। কুরাইশরা যেহেতু প্রথমে চুক্তি ভঙ্গ করলো, তাই তিনি আর সময় নিলেন না। এবার মহানবী (স) মক্কায় অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে নিয়েই, মুসলমানদের একত্রিত হতে বললেন।

কুরায়শরাও সন্ধির বরখেলাফ করার পরিণাম কি হতে পারে, খুব শীঘ্রয় বুঝতে পেরেছিলো তারা। এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম চিন্তা করে, তারা এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলো। সেই সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে, হোদায়বিয়ার সন্ধির নবায়নের জন্যে মদীনায় পাঠাবে।

এদিকে আবু সুফিয়ান মদীনায় পৌছে, মহানবী (স) কাছে গিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলেন। মহানবী (স) তাকে কোন জবাব দিলেন না। আবু সুফিয়ান হযরত আবু বকর (রা) কাছে গিয়ে, তাকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন মহানবী (স) এর সাথে আলোচনা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) অসম্মতি প্রকাশ করলেন। এরপর আবু সুফিয়ান পর‌্যায়ক্রমে হযরত ওমর (রা.), হযরত আলী (রা.) কাছে গেলেন। কিন্তু কেউ তার প্রস্তাবে রাজি হলো না।

অবশেষে শত চেষ্টা করেও সন্ধির নবায়নে ব্যার্থ হয়ে, আবু সুফিয়ান মক্কায় চলে গেলেন। অত:পর কোরায়শদের কাছে গেলে, তারা তাকে ঘিরে ধরে এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। আবু সুফিয়ান বললেন, সন্ধির নবায়নের বিষয়ে কথা বলেছি কিন্তু মহানবী (স) কোন জবাব দেননি। মহানবী (স) এর জবাব না দেওয়ার অর্থ কি হতে পারে! মক্কার কাফেরদের তা আর বুঝতে দেরী হলো না।

                                         ভিডিও দেখুন (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

মক্কা অভিমুখে মুসলিম বাহিনী

মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে গোটা মুসলিম বাহিনী সমবেত হলো এবং মহানবী (স) এর চূড়ান্ত নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এবার মক্কার লোকেরাও জানত-মুসলিমরা এমন অবস্থায় পৌছে গেছে যে, তাদের আর পরাজিত করা সম্ভব নয়। এবার শুধু মক্কার কুরাইশরা ছিল একদিকে, আর মুসলিম সহ গোটা আরবের প্রায় সব গোত্র ছিল অপরদিকে। আরবের ইতিহাসে এ ধরণের মেরুকরণ আগে কখনও দেখা যায় নি।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক অষ্টম হিজরীর ১০ই রমযান। মহানবী (স) এক মহাবিজয়ের উদ্দেশ্যে, মক্কার অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ১০ হাজার সাহাবা। মদীনার তত্ত্বাবধানের জন্যে, আবু রাহাম গেফারী (রা) কে নিযুক্ত করা হয়। জাহাফা বা তার আরো কিছু পথ এগিয়ে যাওয়ার পর, মহানবী (স) এর সাথে তার চাচা, হযরত আব্বাসের সাথে দেখা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে, সপরিবারে মদীনায় হিজরত করতে যাচ্ছিলেন। তিনিও মহানবী (স) এর সঙ্গি হলেন।

উসপান ও আমাজের মধ্যবর্তী, কুদাইদ নামক স্থানে মুসলিম বাহিনী ইফতার এবং যাত্রা বিরতি দেয়। কুদাইদ থেকে মুসলিম বাহিনী আবার রাওনা দেয়। পথিমধ্যে বনি সুলাইমা গোত্রের ১০০০ এবং বনি মুযাইনার গোত্রের ১০০০ জন্য সৈন্য মহানবী (স) এর কাফেলায় যোগদান করে। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা হতে ছয় ক্রোশ দূরে, `মাররুম‘ নামক স্থানে পুনারায় যাত্রা বিরতি দেন। সন্ধার পরে রান্নার জন্য আগুন জ্বালিয়ে দিলে, গোটা এলাকায় অভূতপূর্ব স্বর্গীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তখন মক্কার কুরাইশরা, মুসলমানদের কাফেলা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করে।

আবু সুফিয়ান সেই রাতে দুইজন সহচর নিয়ে, মুসলিম শিবিরের নিকটবর্তী হয়ে, গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে আসলে, হযরত উমর (রা) তাদের বন্দি করে, মহানবী (স) এর নিকট নিয়ে আসেন। ইনি হলেন সেই আবু সুফিয়ান! যিনি দীর্ঘ ২১ বছর মহানবী (স) এবং তার সাহাবাদের উপর, অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিলেন। মহানবী (স) চাইলে, মুহূর্তেই তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু মহানুভব মহানবী (স) অতীতের সব দু:খ, কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন।

মানবতার মুক্তির দূত মহানবী (স), আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা করে দেন। আবু সুফিয়ান ও মহানবী (স) এর মহানুভবতার কথা উপলীদ্ধ করতে পেরে, তার সহচর সহ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস (রা) মক্কায় গিয়ে, মহানবী (স) এর পক্ষে জনমত তৈরি করতে থাকেন। মহানবী (স) এর নির্দেশ মোতাবেক, আবু সুফিয়ান দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন

` হে কুরাইশগণ আজ হযরত মুহাম্মদ (স) দশ হাজার সৈন্য সহ মক্কার উপকষ্ঠে উপস্থিত। যে ব্যাক্তি কা`বা গৃহে আশ্রয় নিবে অথবা যে ব্যাক্তি নিজ গৃহে আবদ্ধ থাকবে, তাদের ভয় নেই। জেনে রাখ,আমি আর এখন তোমাদের দলপতি নই, আমি এখন মুসলিম।

মরু উপত্যকা সোবহে সাদেকের শুভ প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গে, আজানের ‍সুমহান ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। সাহাবীগণ শয্যা ত্যাগ করলেন এবং ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করলেন। নামাজ শেষেই মহানবী (স) মুসলিম বাহিনীকে যাত্রার আদেশ দিলেন। যাত্রাপথে কুরাইশ কাফেররা, বিচ্চিন্ন কিছু প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও, তা তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারল না। মোটামুটি রক্তপাত ছাড়াই মুসলিমরা বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করল।

নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে আসার উচ্ছাস, মুসলমানদের মনে তখনই অনুভূত হলো, যখন সবাই উপলদ্ধি করলেন যে, এই দিনটিতেই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে ইসলাম জয়ী হলো, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য লাভ করল বিজয়। পবিত্র কাবাঘরে এতদিন যে ৩৬০ টি মূর্তি রাখা হয়েছিল, সেগুলো সব ধ্বংস করা হলো। পুরো স্থানটি এক আল্লাহর ইবাদতের পবিত্র করা হলো। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (স) সবাইকে নি:শর্তে ক্ষমা করে, এক নজির বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইতিহাসে এটিই একমাত্র রক্তপাতহীন মহাবিজয়।

অন্যদিকে মক্কার লোকেরা তখন বুঝতে পারল যে, তারা এতদিন যে মুর্তিগুলোর পূজা করেছে, তারা মূলত মাটির বানানো পুতুল ছাড়া কিছুই নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। তখন এক আল্লাহ ও তার রাসূল (স) এবং পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম ইসলামের, সত্যতা বুঝতে পেরে, তারা দলে দলে মুহাম্মদ (স) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।

যে মহামানবকে তারা, এক সময় জন্মভূমি ত্যাগ করে, মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিল, অবশেষে তাঁর নেতৃত্বকেই, তারা চূড়ান্তভাবে মেনে নিল। এরপর মহানবী (স) এর প্রতিনিধি আত্তার বিন আসিদের তত্ত্বাবধানে, কুরাইশগণ মক্কার শাসনকার‌্য পরিচালনা করতে থাকে। মক্কায় ২০ দিন অবস্থান করে মহানবী (স) মদিনায় ফিরে যান। এভাবে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (স) হয়ে উঠলেন আরবের অবিসংবাদিত নেতা এবং মুসলমনরা হয়ে উঠল আরবের অপ্রতিরুদ্ধ জাতী।

পরবর্তী অংশ পড়ুন :তায়েফ অভিযান : মহানবীর (স) ঐতিহাসিক বিজয়


তথ্যের উৎস সমূহ:

* আর রাহীকুল মাখতুম-

        লেখক : আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী

         অনুবাদ : খাদিজা আখতার রেজায়ী।

১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।

২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান 

৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট  

        




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ