মহানবীর (স) বিদেশে দূত প্রেরণ ।

                                          

               পূর্বের অংশ পড়ুন : মুলতবি হজ

ষষ্ঠ হিজরি মোতাবেক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মক্কা-মদিনার মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ স্থগিত থাকে। অন্যদিকে একই বছরে খায়বারের যুদ্ধে ইহুদি এবং আরব বেদুঈন গোত্র সমূহ মুসলমানদের নিকট পরাজিত হলে, সমগ্র আরব উপদ্বীপে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিলনা, যারা ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে পারে। এই সুযোগে প্রিয় নবী (সা.) ইসলাম প্রচারের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। শান্তি, সহযোগিতা, সহাবস্থান ও সংহতির বার্তা নিয়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র পত্রাবলি, আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক স্থাপন ও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয় বিভিন্ন জনপদ কিংবা সাম্রাজ্যে।

মহানবী (স) প্রথম পত্রটি আবিসিনিয়ার শাসক নাজ্জাশির নিকট প্রেরণ করেন। তিনি রাজা নাজ্জাসীর নিকট দূত হিসেবে হজরত আমর ইবনে উমাইয়া (রা.) কে পাঠান। নাজ্জাশি পূর্ব থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। মক্কার জুলুম অত্যাচারের মুখে মুসলমানরা দুবার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। নাজ্জাশি তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেন। তিনি নবীজির চিঠি পেয়ে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন। সিংহাসন থেকে নেমে আসেন এবং নবীজির প্রতি ঈমান এনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজির জীবদ্দশায় তার ইন্তেকাল হয়।

দ্বিতীয় পত্রটি প্রেরণ করেন মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান খ্রিস্টান শাসনকর্তা মুকাওয়াকিসের কাছে। মুকাওয়াকিস মুসলিম পত্রবাহককে সম্মান জানান এবং রাসূল (স)-এর জন্য অনেক উপঢৌকন পাঠান। তিনি মহানবী (স) কে নবী হিসেবে বিশ্বা্স করলেও রাজনৈতিক কারণে ইসলাম কবুল করেননি।

এরপর মহানবী (স) রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে তৃতীয় পত্র নিয়ে দূত হিসেবে পাঠান হজরত দেহিইয়াতুল কালবি (র) কে। রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস সাদরে এবং সসম্মানে মুসলিম দূতকে অভ্যর্থনা করেন। তিনি মহানবীর তিনি পত্র পেয়ে বেশ প্রভাবিত হন। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) ইঞ্জিল বা বাইবেলে উল্লেখিত শেষ নবী। এমনকি ইসলাম গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুতও হন। কিন্তু সভাসদদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে রাজত্ব হারানোর আশঙ্কায় ইসলাম গ্রহণ করেননি।

                                               

মহানবী (স) চতুর্থ পত্র নিয়ে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের নিকট হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ সাহমি (রা) কে প্রেরণ করেন। ক্ষমতাগর্বী খসরু পারভেজ রাসূল (স)-এর পত্রকে প্রকাশ্য রাজদরবারে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন এবং তার ইয়েমেনী গভর্নর বাজানকে এইমর্মে নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন হযরত মুহাম্মদ (স) কে গ্রেফতার করে তার দরবারে হাজির করেন।

ইয়েমেনী গভর্নর বজানের দূত অনতিবিলম্বে মদীনায় পৌঁছে মহানবী (স) -এর কাছে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের গ্রেফতারি ফরমানের কথা জানান। অপরদিকে মহানবী (সা.) তাদেরকে পারস্য সম্রাটের নিহত হওয়ার ঘটনা বলেন। নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তারা সংবাদের সত্যতা জানতে পারে। এই ঘটনার পর মহানবী (স) এবং ইসলামের সত্যতা বুঝতে পেরে ইয়েমেনের শাসক বাজান ইসলাম গ্রহণ করেন।

অন্যদিকে মহানবী (স)এর পত্র খসরু পারভেজ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার সংবাদ শ্রবণ করে মুহাম্মদ (স) বলেছিলেন `` আমার পত্রকে যেমনিভাবে সে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেছে, ঠিক তেমনিভাবে মুসলমানদের হাতে তার রাজ্যও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।' মুহাম্মদ (স) এর মুখ নি:সৃত এই বানী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছিল। অতি অল্প সময়ের ভেতরেই পারভেজের সাম্রাজ্য মুসলিমদের পদানত হয়েছিল আর আল্লাহর নবীর পত্র ছিঁড়ে ফেলার অমার্জনীয় অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ঐ রাতেই সে তার নিজ পুত্রের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিল।

মহানবী (স) পঞ্চম পত্র প্রেরণ করা হয় বাহরাইনের শাসনকর্তা আল মুনযির বিন তামিমির প্রতি। আল মুনযির মহানবী (স)-এর পত্র পেয়ে ইতিবাচক সাড়া দেন এবং তিনি তার রাষ্ট্র পরিচালনায় মহানবী (স) -এর পরামর্শ নির্দেশিকা চেয়ে পত্র পাঠান।

এরপর মহানবী (স) ষষ্ঠ পত্র প্রেরিত করেন ইয়ামামার রাষ্ট্রপ্রধান হুযা বিন আলীর কাছে। রাসূলুল্লাহ (স) তাকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান এবং অবহিত করেন যে, অচিরেই ইসলামী রাষ্ট্র খাফা শহর হতে আল-হাফেবের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করবে। তিনি তাকে আরো জানান, ইসলাম কবুল করলে আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন এবং আপনার যাবতীয় সম্পদ আপনারই থাকবে। কিন্তু হুযা বিন আলী মহানবী (স) এর দূতকে সাদরে গ্রহণ করেন নাই।

এরপর সপ্তম পত্র প্রেরণ করেন রোমান সাম্রাজ্যের অধিনস্ত সিরিয়ার গাচ্ছান বংশীয় খ্রিস্টান রাজা সুরাহবিলের কাছে। কিন্তু রাজা সুরাহবিল ক্রোধান্বিত হয়ে মুসলিম দূত হারিস বিন উমাইয়া (র) কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই বিশ্বাসঘাতকামুলক হত্যাকান্ড এবং আন্তর্জাতীক আইনের অবমাননার কারণে মুসলমানদের এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল।

পরবর্তী অংশ পড়ুন : মু‘তার যুদ্ধ

তথ্যের উৎস সমূহ:

১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান 
৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।

৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট  

                                   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ