বখতিয়ার খলজীর বাংলা ও বিহার বিজয় |

                                                                                      

পূর্বের অংশ পড়ুন : বখতিয়ার খলজী : প্রথম বাংলা বিজয়ীর সংগ্রামী জীবনকথা |

১২০২ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী দিল্লির শাসন কর্তা কুতুব উদ্দীন আইবেক থেকে খিলাত তথা অভিনন্দনের চিহ্ন স্বরূপ সম্মান সূচক পোশাক, প্রশংসা এবং উৎসাহ লাভ করেন। এরপর খিলাত লাভ ও স্বীয় শক্তিতে উৎসাহিত হয়ে বখতিয়ার খলজী নবোউদ্যামে সমারাভিযান পরিচালনার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলেন। এভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকায় অভিযান চালিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় তিনি একদিন তিনি অপ্রত্যাশীতভাবে প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গের মত এক স্থানে উপস্থিত হন। স্থানটি দুর্গ মনে করে অবরোধ করলেন কিন্তু প্রতিপক্ষের কোন বাধা প্রদান ছাড়াই বখতিয়ার খলজী স্থানটি জয় করেন।

 

প্রাচীর বেষ্টিত স্থানটি জয় করার পর তিনি দেখলেন সেখানকার অধিবাসীরা সকলেই মস্তক মুন্ডিত এবং স্থানটি বইপত্রে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারলেন এটি আসলে কোন কেল্লা বা দূর্গ নয়, এটি একটি বৌদ্ধ বিহার এবং মস্তকমন্ডিত সবাই বৌদ্ধ ভিক্ষুক। বিহারটির নাম ছিল উদন্তপুরী বিহার। অতপর এই বিহারের নাম অনুসারে মুসলমানরা ঐ স্থানের নাম দিলেন বিহার এবং আজ পর‌্যন্ত শহরটি বিহার বা বিহার শরীফ নামে পরিচিত। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী পুনরায় বিহারে অভিযান পরিচালনা করে হিন্দু শাসকদের পরাজিত করে বিহারে প্রথমবার ইসলামের বিজয় পতকা উড্ডীয়ন করেন।


                                                           বখতিয়ার খলজী

এরপর তিনি বিজিত অঞ্চলে সমারিক ঘাটি স্থাপন ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।বখতিয়ার খলজী বিহার জয়ের পর অনেক ধনরত্নসহ দিল্লির শাসক কুতুব উদ্দীনের সাথে সাক্ষাত করতে যান। কুতুব উদ্দীন বখতিয়ারে আনুগত্য প্রকাশে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তাকে বাংলা বিজয়ের জন্য উৎসাহিত করেন। বিহারে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর বখতিয়ার খলজী এবার বাংলা তথা বঙ্গ বিজয়ের জন্য সংকল্প করলেন। তখন বাংলায় চলছিল সেন শাসন। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন ছিল বাংলার শাসক। সেনরা হিন্দু ধর্মবলম্বী হলেও, তাদের মাঝে জাতিভেদ প্রথা ছিল চরম। বিশেষ করে নিন্ম বর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। তাদের উপর উচ্চবর্ণের হিন্দু শাসক শ্রেণীর অত্যাচার ও নিপীড়ন ছিল নিত্যনৈমত্তিক বিষয়।

 আরও পড়ুন:বাংলায় সেনদের পতন ও মুসলিম শাসনের উত্থান।                                                                

অতঃপর অত্যচারিত, নিপীড়িত ও নির‌্যাতিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে বাংলার বুকে আবির্ভাব ঘটে মুসলিম বীর বখতিয়ার খলজীর। অবশেষে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিজয়ের উদ্দেশ্যে বিহার থেকে গঙ্গা ও ঝাড়খন্ডের পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে নদীয়া নগরীর দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত হন তিনি।

এ সময় বাংলার রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল গৌড়। আর নদীয়া ছিল তার রাজনিবাস ও দ্বিতীয় রাজধানী। লক্ষণ সেন নদীয়া বা নবদ্বীপে বাস করতেন। তৎকালীন সময়ে রাজার সাথে রাজ্যের উত্থান-পতন নির্ভর করত বলে বখতিয়ার খলজী প্রথমেই নদীয়া জয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকাল। বেলা তখন ঠিক দ্বিপ্রহর। রাজা লক্ষণ সেন মধ্যহ্নভোজে ব্যস্থ। ঠিক এ সময় বখতিয়ার খলজী বণিকের ছদ্মবেশে মাত্র ১৭ জন মুসলিম বীর সেনানী নিয়ে নদীয়ার রাজ প্রাসাদে আক্রমণ করেন। তার আক্রমণের ফলে প্রাসাদ অরক্ষিত রেখে সৈন্য-সামান্ত, উজির-মন্ত্রী সবাই প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বখতিয়ার খলজীর দ্বিতীয় দল এসে নগরের ভেতরে এবং তৃতীয় দল এসে নগরের ফটকে অবস্থান নেয়।

     আরও পড়ুন:বাংলায় পাল শাসনের ইতিহাস                                                          

সমস্ত নগর তখন প্রায় অবরুদ্ধ। বখতিয়ার খলজীর আক্রমণের হাত থেকে কোন রক্ষা নেই দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত রাজা লক্ষণ সেন সপরিবারে গোপনে নৌকা যোগে পূর্ব বঙ্গের দিকে পালিয়ে যান এবং বর্তমান ঢাকা জেলার সোনারগাওয়ের নিকটবর্তী বিক্রম পুরে অবস্থান নেয়। ফলে বিনা বাধায় নদীয়া ও পার্শবর্তী অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। এভাবে বাংলায় প্রথম ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলিত হয়।

           

নদীয়া বিজয়ের পর বখতিয়ার খলজী তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী বিজয়ের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। কিন্তু রাজা লক্ষ্মসেন পরাজয় বরণ করার কারণে গৌড়ের সেনাবাহিনী বখতিয়ার খলজীকে বাধা প্রদান না করে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর বখতিয়ার খলজী খুব সহজেই লক্ষ্মণাবতী জয় করেন। লক্ষ্মণাবতী বা গৌড় মুসলমি শাসনের সময় লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। লখনৌতি তার রাজধানী হলেও তিনি দিনাজপুরের দেবকৌট থেকে রাজ্যের শাসনকার‌্য পরিচালনা করতেন। লখনৌতি বিজয়ের পর বখতিয়ার খলজী উত্তর বঙ্গ বা বরেন্দ্র বিজয় করেন।

বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের গুরুত্ব ছিল সুদূর প্রসারী ও যুগান্তকারী। এ বিজয়ের ফলে বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনের অবসান এবং মুসলিম শাসনের সূচনা হয়েছিল। মুসিলম আধিপত্য স্থাপনের সাথে সাথে ইসলাম ধর্মের প্রচার- প্রসার ও ‍বৃদ্ধি পাই। এ সময় বহু সূফি সাধাক, ধর্মপ্রচারকগণ বাংলায় আগমন করেন এবং বহু মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এতে হিন্দু সভ্যতার স্থলে ইসলামী সভ্যতার দ্বার উন্মোচন হয়ে এক নব যুগের সূচনা হয়।

আরও পড়ুনবাংলাদেশে ইসলামের আগমন: কিভাবে ও কখন ?

💻তথ্যের উৎস: 📌বাংলাদেশের ইতিহাস- কে আলী 📌বাংলাদেশের ইতিহাস- ড. মো: শাহাজাহান 📌বাংলার ইতিহাস- সূনিতী কুমার চট্টোপাধ্যায় 📌ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস- ড.এ.কে.এম আব্দুল আলীম 📌ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান 📌 উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন অনলাইন ওয়েবসাইট। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ