সুলতান তুঘ্রিল বেগ : সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা |

                                                            

পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন তুঘ্রিল বেগ : মুসলিম খেলাফতের রক্ষক !! ইসলামী খেলাফতের ইতিহাস ||

একাদশ শতাব্দীর শুরুতে ওগোজ তুর্কি নেতা সেলজুক বেগের হাত ধরে উত্থান হয় সেলজুক রাজবংশের। যিনি বাকায়িকের পুত্র এবং অঘুজ খানের পৌত্র ছিলেন। সেলজুক বেগের মিকাইল এবং পিগু আরসালান নামে দুইজন পুত্র ছিল। আরসলানের বংশধরেরা পরবর্তীতে আনাতোলিয়াকে কেন্দ্র করে রোমের সেলজুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অপরদিকে মেকাইল বেগের পুত্ররা হলেন ইব্রাহীম, চাগরীবেগ এবং তুগ্রিলবেগ মুহাম্মদ। তুঘরিল বেগ ৯৯০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বালক বয়সেই তার পিতা মিকাইল বেগ মারা যায়। বাবার মৃত্যুর পরে তুঘ্রিল তার ভাইয়েরা তাদের পিতামহ সেলজু বেগের নিকট লালিত-পালিত হন।

                                                              

 

সেলজুক বেগের সময় একটি ক্ষুদ্র বসতির মাধ্যমে সেলজুক রাজবংশের পথচলা শুরু হলে ও তার দুই নাতি চাগরি বেগ তুঘরিল বেগ পরবর্তীতে নিজেদের অধীনে পারসিকদের অঞ্চলে খণ্ড সাম্রাজ্য কায়েম করে। চাগরি বেগ খোরাসান এলাকা বিজয় করে এবং তুঘরিল বেগ বিজয় করে পশ্চিম ইরান এবং মেসোপটেমীয় এলাকা। মূলত ১০৫৫ খ্র্রিস্টাব্দে সেলজুক বেগের মৃত্যুর পর সেলজুক তুর্কিদের দলপতি নির্বাচিত হন তার পৌত্র তুঘ্রিল বেগ। তার সময় থেকে সেলজুক তুর্কিদের উত্থানের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। আর তাই তুঘ্রীল বেগকে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

                                                    

সুলতান মাহমুদ

প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানের গজনীর সিংহাসনে যখন সুলতান মাহমুদ গজনবী উপবিষ্ট ছিলেন, তখন সেলজুক পুত্র পিগু আরসালানের নেতৃত্বে থাকা সেলজুক তুর্কিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি গজনী রাজ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এতে সুলতান মাহমুদ সেলজুকদের দুর্ধর্ষতা ও শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে তাদের খোরাসানে নির্বাসিত করেন। আরসালেনের পর তুগ্রিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকগণ খোরাসানে পুনরায় সংঘবদ্ধ হন। এখানে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে এবং মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য স্থাপন করার সংকল্প তাদের অন্তরে উদিত হয়।

                 আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস      

অতপর সুলতান মাহমুদ গজনবীর আশংকা সত্যে পরিণত হয়। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে তুঘ্রীল বেগ ও তার ভাই চাগরী বেগ খোরাসান অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে সুলতান মাহমুদের পুত্র সুলতান মাসুদকে পরাজিত করে প্রথমে মার্ভ ও নিশাপুর বিজয় করেন। এরপর ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাসুদকে পুনরায় পরাজিত করে গজনী রাজ্য দখল করে। এর অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বলখ, জুরজান, তাবারিস্তান, খাওয়ারিজম,হামদান,আল রায়ি ও ইসপাহান বিজয় করে।                                                 

বিজিত অঞ্চলে সেলজুকরা একটি শক্তিশালী স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যা ইতিহাসে সেলজুক সাম্রাজ্য নামে পরিতি। সমসাময়িক বিশ্বে এই সাম্রাজ্য একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব হয়। যাদেরকে খ্রিস্টান পরাশক্তি রোমনরা পর‌্যন্ত ভয় পেত। মুসলিম হিসেবে তারা ছিল ধর্মপ্রাণ ও খোদাভিরু। তাছাড়া এমন এক সময় সেলজুকদের আবির্ভব হয়, যখন আব্বাসীয় সুন্নি মুসলিম খেলাফত মিশরের পথভ্রষ্ট শিয়া ফাতেমী খেলাফতের কাছে তাদের গৌরব ও সম্মান হারাচ্ছিল।       


একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আব্বাসিয় খলিফাদের হাতে ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। এ সময় অতীতের সমগ্র মুসলিম খেলাফতের, মিশর ও উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীগণ, উত্তর সিরিয়া ও মেসোটেমিয়ায় অশান্ত আরব যোদ্ধাদের হাতে, তাছাড়া অনেকে আবার স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। পারস্য, ট্রান্স অক্সিয়ানা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের দেশগুলু বুইয়ায়া রাজবংশ ও গজনী সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত ছিল।

 ৯৪৪ থেকে ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যন্ত শিয়া বুয়াইয়া আমিরগণ আব্বাসীয় খলিফাদের ক্রিড়ানকে পরিণত করে শাসনকার‌্য পরিচালনা করতে থাকে। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের অনেকেই বুয়াহিদদের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি। অবশেষে ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্বল ও ক্রিড়ানক আব্বাসীয় খলিফা আল কাইম বিল্লাহ বুয়াইয়া আমিরের প্রতাপ-প্রতিপত্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সেলজুক শাসক তুঘ্রীল বেগেকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান।   

তুগ্রিল বেগ ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর বাগদাদ অবরোধ করেন। এই অবরোধের ফলে শেষ বুয়াইয়া আমির মালিক আর রহিম পলায়ন করেন। বাগদাদের সামরিক গভর্নর ও তুর্কি জেনারেল আল বাসারিরি রাজধানী ত্যাগ করেন। বৃদ্ধ এবং দুর্বল ক্ষমতাহীন আব্বাসিয় খলিফা আল কাইম তুঘ্রীলকে পরিত্রাণকর্তা হিসেবে রাজদরবারে সাদরে আমন্ত্রণ জানান।

খলিফা আর কাইম বাগদাদের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে কৃতজ্ঞতর নিদর্শনস্বরুপ তিনি তুঘ্রিলকে সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব দান করেন। খলিফা তাকে প্রাচ্য ও প্রাতীচ্যের সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন। এর ফলে তুঘ্রিল বেগ হয়ে উঠেন সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান। সুলতান তুঘ্রীল একজন প্রতিভাশালী ও সুদক্ষ শাসনকর্তা ছিলেন। সুলতান হিসেবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি খলিফা আল কাইমকে শ্রদ্ধা করতেন।

তুঘ্রিল বেগের মুদ্রা

 তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদের পরিবর্তে মার্ভে স্থাপন করেন। সুলতান তুঘ্রিল শুধু আব্বাসীয় খলিফার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে ক্ষান্ত হননি বরং দেশের পর দেশ জয় করে তিনি বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের সিমান্তে উপনীত হন এবং বায়জান্টান সম্রাটকে কর প্রদান করতে নিদের্শ দেন। ১০৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডোসিয়া ও ফিজিয়া বিজয় করে বায়জান্টাইনদের বিতাড়িত করেন।

ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, “সুলতান তুঘ্রীলের শাসনামলে সেলজুকগণ এশিয়ার একটি প্রতাপশালী জাতিতে পরিণত হয়। সমসাময়িক জাতিদের তুলনায় তারা ছিল অনেক উন্নত। তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের একনিষ্ট সেবক রুপে পরিচিত হয়। ঐতিহাসিক ইবনে আসির তাকে ধৈরর‌্যশীল, জ্ঞানী, ধার্মিক, অনাড়ম্বর এবং বিদ্যা অনুরাগি বলে অভিহিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যে কোন নগর বিজয় করলে, সেখানে বিজয়ের স্বরণার্থে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করতেন।   

অতঃপর ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই মহান তুর্কি মুসলিম বীর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান তুঘ্রিলের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা চাগরীবেগ দাউদের পুত্র আলপ আরসালান সেলজুক সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, সুলতান তুঘ্রীল, তার ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান আলপ আরসালান এবং  সুলতান আলপ আরসালাসের পুত্র মালিক শাহের শাসনকাল সেলজুক অভ্যুত্থানের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।

পরবর্তী পর্ব পড়ুন : সুলতান আল্প আরসালান : গর্জে ওঠা সেলজুক সিংহের বীরত্বগাঁথা

                       ভিডিও দেখুন:

                                                

তথ্যের উৎস:

  • আরব জাতীর ইতিহাস - ড. লৎফর রহমান                  
  • সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লবি 
  • ইসলামের ইতিহাস - ড. মাহমুবুর রহমান
  • উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট

                                             

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ