আরও পড়ুন : সুলতান আল্প আরসালান : গর্জে ওঠা সেলজুক সিংহের বীরত্বগাঁথা |
সেলজুক
সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান মালিক শাহ ১০৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মকালে তার
নাম ছিলো জালাল আল-দৌলা মালিক বেগ। ১০৭২ সালে তিনি তার পিতা সেলজুক সুলতান আল্প
আরসালানের উত্তরাধীকারী হন। এবং মালিক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১০৯২ সালে তার
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। তার শাসনকালে সেলজুক সাম্রাজ্য
অর্ধ-পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
শৈশবের
বেশিরভাগ সময় তিনি ইসফাহানেই অতিবাহিত করেন। ১০৬৪ সালে মালিক-শাহ ততক্ষণে মাত্র
নয় বছর বয়সী, নিজাম আল-মুলকের সাথে সেলজুক সাম্রাজ্যের উজির হিসেবে নিযুক্ত হন।
১০৬৬ সালে মার্ভে সুলতান আলপ আরসলান মালিক-শাহকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত
করেছিলেন এবং মালিক শাহকে ইসফাহানের শাসন ভার অর্পণ করেন। ইস্পেহান ম্যাপ
১০৭২ সালে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনাকালে সুলতান আল্প আরসালান আততায়ীর হাতে চুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। বাবা আল্প আরসালানের মৃত্যুর পরে মালিক-শাহ সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু মালিক-শাহ শান্তিপূর্ণভাবে সিংহাসনে প্রবেশ করতে পারেননি। সে সময় তার চাচা কাওয়াড়ের সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। তার চাচাও চাইছিলেন সিংহাসনের অধিকার নিজের কাছে রাখতে।
আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস
আর
এর জের ধরেই, পিতার হত্যাকান্ডের পর সুলতান মালিক শাহকে তার চাচা কাওয়াড়ের সাথে
মোকাবেলা করতে হয়। ১০৭৩ সালে হামদানের কাছে একটি যুদ্ধ হয়েছিল, যা তিন দিন
স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধে সুলতান মালিক শাহ কাওয়াড়কে পরাজিত করেন । কাওয়াড় তখন
করুণার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং এর বিনিময়ে ওমানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি
দিলেন। ফলে মালিক শাহ চাচার প্রতি দয়া দেখান এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।
তবে
সেসময় নিজাম আল-মুলক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ তিনি দাবি করেন যে, তাকে
ছেড়ে দেওয়া দুর্বলতার ইঙ্গিত। কিছুক্ষণ পরে কাওয়াড়কে তীরের সাহায্যে শ্বাসরোধ
করে হত্যা করা হয়েছিল, তার দুই পুত্রকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ধারনা করা হয়,
সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে এটি নিজামুল মুলকের আদেশেই করা হয়৷ মালিক শাহ সেলজুক
সাম্রাজ্যের প্রধান হলেও তার উজির নিজামুল মুলক ছিল অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাকে
ছাড়া সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
বস্তুত নিজামুল মুলকের দ্বারাই সাম্রাজ্যের শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান ছিল। তার গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত। রাজ্যের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মালিক শাহর উজিরকে নিজামুল মুলক উপাধি দেওয়া হয়েছিল৷ নিযামের অধীনে সেলজুক সেনাবাহিনী গজনভিদের খোরাসানে অবরুদ্ধ করে রাখে, ফাতেমীদেরকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করে, সেলজুক রাজত্বের দাবিদারদের পরাজিত করে, জর্জিয়াকে করদ রাজ্যে পরিণত করে, আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে। আল্প আরসালান বেগের সময়েও তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের উজির ছিলেন।
চাচার সাথে
বিরোধের পরে মালিক-শাহ করাকানিদের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, যিনি আল্প-আরসলানের
মৃত্যুর পরে তুখারিস্তান আক্রমণ করেছিলেন। তুখারিস্থান একসময় মালিক-শাহের ভাই
আয়াজ দ্বারা শাসিত হতো। কারাখানিদের সাথে একটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আয়াজ নিহত হন।
মালিক-শাহ অবশেষে কারাখানিদদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হন।নিজামুল মুলক
আরও পড়ুন: সুলতান আল্প আরসালান
তারপরে মালিক-শাহ তার অন্য ভাই শিহাব আল-দ্বীন তেকিশকে তুখারিস্তান ও বালখের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। একই সময়কালে, গজনভিদ শাসক ইব্রাহিম উত্তরাঞ্চলীয় খোরাসানের সেলজুক অঞ্চল দখল করতে মালিক শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালের গজনভিদ মালিক শাহর সাথে চুক্তি করে এবং পরবর্তী কালে তাঁর মেয়ে গওহর খাতুনকে তৃতীয় ইব্রাহিমের পুত্র মাসউদ এর সাথে বিবাহ দেন।
একই বছর তিনি চাচা কাওয়াড়ের ছেলে তুরান শাহকে কেরমানের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। মালিকের রাজত্বকালে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই সময়েই জালালী ক্যালেন্ডারের সংস্কার করা হয় ইসফাহান পর্যবেক্ষণে।
১০৮৯
সালে, মালিক-শাহ স্থানীয় ধর্মপ্রচারকদের সহায়তায় সমরখন্দ বিজয় করেছিলেন এবং ঐ
অঞ্চলের করখানিদ শাসক আহমেদ খান ইবনে খিজরকে বন্দী করেছিলেন। যিনি তার স্ত্রী
তেরকিন খাতুনের ভাগ্নে ছিলেন। ১০৭৫ সালে জালালী ক্যালেন্ডার সংস্কার করা হয় এবং
মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুক শাসনাধীন অঞ্চল জুড়ে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
গড়ে তোলা হয়।
![]() |
নিজামিয়া মাদ্রাসা, বাগদাদ |
১০৯২ সালে বাগদাদ যাওয়ার পথে সিহনার কাছে নিযামুল মুলক শিয়া ইসমাঈলী বাতেনীদের হাতে নিহত হন। নিজামুল মুলুকের মৃত্যুতে সেলজুক সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বে আঘাত হানে। নিজামুল মুলুকের মৃত্যুর পর মালিক শাহ নিজেও অসুস্থ বোধ করেন এবং কয়েক মাস পর মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর সেলজুক রাজবংশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। উত্তরাধীকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকরা সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
আরও পড়ুন:নিজামুল মুলকের জীবনী
১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া প্রথম ক্রুসেডের ফলে সেলজুক সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এই ক্রুসেডের ফলে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ মুসলিমদের থেকে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা দখল করে। প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য মালিক শাহের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর নির্ভর করেছে। যুক্তিযুক্তভাবে তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হওয়া সত্ত্বেও, মালিক-শাহ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং বিনয়ী।
সুলতান মালিক শাহ সেলজুক সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠই ছিলেন না, বরং তৎকালীন বিশ্বের সকল শাসকদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন। তার রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে কাশ্মির হতে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর এবং উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সুলতান মালিক শাহের মৃত্যুর সাথে সাথে সেলজুক সাম্রাজ্যের শ্র্রেষ্ঠত্ব ও ঐক্য বিলুপ্ত হয়।
সুলতান মালিক শাহ তার জৈষ্ঠ পুত্র বারকিয়ারুককে সাম্রাজ্যেল উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনিত করেন। কিন্তু সুলতানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী তুরখান খাতুন এর অনুরোধে খলিফা তার শিশুপুত্র চার বছর বয়সি মাহমুদকে সুলতানের পদমর্যদা দান করেন। ফলে সুলতান মাহমুদ ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তবে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বারকিয়ারুক সুলতান মাহমুদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেলজুক সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেন।তথ্যের উৎস:
- আরব জাতীর ইতিহাস - ড. লৎফর রহমান
- সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লবি
- ইসলামের ইতিহাস - ড. মাহমুবুর রহমান
- উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট
0 মন্তব্যসমূহ