আরও পড়ুন : সুলতান তুঘ্রিল বেগ : সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সুলতান |
সুলতান আলপ আরসালান সামরিক দক্ষতা,
বীরত্ব এবং লড়াইয়ে পারদর্শিতার জন্য আলপ আরসালান উপাধি লাভ করেন। তুর্কি ও
তুর্কমেন ভাষায় এর অর্থ “বীর সিংহ”। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ। তাঁর শাসনকালে তিনি
আমুদরিয়া থেকে টাইগ্রিস পর্যন্ত পারস্যের একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ
করেন।
সুলতান আল্প আরসালান ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রথম স্বাধীন
সুলতান তুগ্রীল বেগের ভ্রাতুষ্পুত্র তথা তুঘ্রীল বেগের ভাই চেগরি বেগের সন্তান।
প্রাথমিক জীবনে তিনি তার চাচা তুঘ্রিল বেগের সাথে ফাতেমী শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করেছিলেন। পরবর্তীতে ১০৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবা চেগরি বেগের ইন্তেকাল হলে তিনি
খোরাসানের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১০৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সেলজুক সালতানাদের মহান স্থপতি ও প্রথম
স্বাধীন সুলতান তুঘ্রিল বেগ শিয়া মতলম্বি বুয়াইয়া আমীরদের পরাজিত করে খলিফা কাইম
বিল্লাহকে বাগদাদের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এর কিছুদিন পরই তিনি মহান
আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। নিঃসন্তান চাচার মৃত্যুর পর চাগরী বেগের পুত্র আল্প
আরসালান সেলজুকদের নতুন সুলতান হন এবং খলিফার নিকট হতে সুলতান উপাধি লাভ করেন।
আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস
তার সময়ে তুর্কী উপজাতিরা দলে দলে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করলে তার পক্ষে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের হারানো রাজ্যসমূহ পুনর্দখল করে একটি সংঘবদ্ধ রাজ্যে পরিণত করতে সম্ভব হয়। এতে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি পায়। ১০৬৪ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান হওয়ার পর বিখ্যাত ইবনে আলী আত তুসিকে সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও নিজামুল মূলক হিসেবে নিয়োগ করেন।
প্রসঙ্গত, নিজামুল মূলক অর্থ সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপক। এই ইবনে
আলী আত তুসিই হচ্ছেন সেই বিখ্যাত নিজামুল মূলক তুসি। যিনি তার মহান কর্মের জন্য
ইতিহাসের অমর হয়ে রয়েছেন। আলপ আরসালান সুলতান হওয়ার পরই সালতানাতের বিভিন্ন
জায়গায় বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে। তাই তিনি প্রথমে এইসব বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত
নেন।নিজামুল মুলক
বিদ্রোহ দমনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি জর্জিয়া দখল করার
পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জর্জিয়া দখল করতে তাকে ব্যাপক বেগ পেতে হয়। অবশেষে
সুলতান এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে যান। সুলতানের বীরত্বের কাছে হার মানে জর্জিয়া।
জর্জিয়ার শাসক বাগারাত ৪র্থ সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেন। পরবর্তী পদক্ষেপ
হিসেবে তিনি এগিয়ে যান আরমেনিয়া রাজ্যের দিকে। এই শহর দখল করতে তিনি শহরের
প্রাচীরের বাইরে থেকে উত্তপ্ত তেলের বোমা নিক্ষেপ করেন। ফলে শহরের লোকজন ভীত হয়ে
সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সফলভাবে দমন
করেন।
আরও পড়ুন: খিজির খাইরুদ্দীন বারবারোসা
সুলতান আলপ আরসালানের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বায়জান্টাইনদের সাথে সংঘর্ষ। জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়া অধিকার করার পর তিনি খয়ে দুর্গে অবস্থান করছিলেন। এদিকে ১০৬৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম বায়জান্টান সম্রাজ্যের রাজা দশম কন্সটান্টিনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রাণি ইউডোকিয়া সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইউডোকিয়াকে বিয়ে করার পর বায়জান্টান সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হন চতুর্থ রোমানোস।
রাজা হয়েই রোমানোস সেলজুকদের আজীবন চুপ করে দিতে ইরান, খোরাসান,সিরিয়া,দখল করতে উদ্যত হন। এই উপলক্ষে বায়জান্টান সম্রাট চতুর্থ রোমানোস তার সেনাপতি ম্যানুয়াল কমিনসকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেলজুকদের পরাজিত করে সিরিয়া দখল করতে প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে বাইজান্টাইন বাহিনী জয়লাভ করে। ফলে তারা সিরিয়ার মানবিজ শহর দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ ও মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালায়।
এই খবর পেয়ে আল্প আরসালান তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসেন। ইকুনিয়ামের কাছে কোন এক স্থানে সেলজুকরা বায়জান্টাইনদের লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে বায়জান্টাইন সেনাপতি ম্যানুয়েল কমেনস ধরা পড়ে। কিন্তু দয়ালু সুলতান তার সাথে শান্তিচুক্তি করে তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। অপরদিকে বায়জান্টান সম্রাট চতুর্থ রোমানোস ক্রুদ্ধ হয়ে বাগদাদ নগরী ধ্বংসকল্পে দুই লক্ষ সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করেন।
আরও পড়ুন: উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস
এই দুঃসংবাদে বিচলিত না হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য সুলতান আল্প আরসালান মাত্র ৪০ হাজার সৈন্যসহ বায়জান্টাইনদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আর্মেনিয়ার দিকে অগ্রসর হন। অবশেষে ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মানজিকার্দের যুদ্ধে আল্প আরসালান স্বল্প সংখ্যক মুসলিম বীর সেনানী নিয়ে বিশাল খ্রিস্টান বাইজান্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে এবং সম্রাটকে বন্দী করেন।
বাইজান্টাইনদের বিপরর্যয়ে মুসলমানগণ সেলজুকদের নেতৃত্বাধীন
সর্বপ্রথম রোমীয় সম্রাটের অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয় এবং এশিয়া মাইনরকেতুর্কীকরণের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুদ্ধে পরাজিত
হওয়ার পর সুলতান আলপ আরসালান বায়জান্টাইন সম্রাটকে হত্যা না করে সন্ধিচুক্তি করার সুযোগ
প্রদান করেন। সন্ধির শর্ত অনুযায়ি সম্রাট তার কন্যাকে সুলতানের পুত্রের সাথে বিয়ে প্রদান,
বার্ষিক কর, মুসলিম বন্দিমুক্তির প্রতুশ্রিতিতে মুক্তি লাভ করেন।মানজিকার্ট ম্যাপ
মুক্তিপণ হিসেবে দশ লক্ষ ও বাৎসরিক রাজস্ব হিসেবে ৩ লক্ষ
৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করতে রোমান সম্রাট সম্মত হন। সুলতার আলপ আরসালান রাজ্য
জয়ের পর এশিয়া মাইনরের শাসনভার জয়গির হিসেবে তার চাচা কুলতিমিশের পুত্র সুলায়মানকে
প্রদান করেন। বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসনকর্তা সুলায়মান তার রাজ্যসীমা উত্তরে হেলস্পন্ট ও
পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং বায়জান্টাইন সম্রাটকে কর দানে বাধ্য
করেন।
আরও পড়ুন: নিজামুল মুলক আত তুসী
এরপর তিনি বিথিনিয়ার নাইসিয়া নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন কিন্তু ক্রুসেডের যুদ্ধে ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে বিথিনিয়া অধিকৃত হলে তিনি এশিয়া মাইনর তথা আনাতোলিয়ার আইকোনিয়াস বা রোমে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এবং পরবর্তীতে এখানেই গোড়পত্তন হয় রোমের সেলজুক সালতানাতের। সুলতান আল্প আরসালান সেলজুক সাম্রাজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাজ্য সম্প্রসারণের একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান।
ঐতিহাসিক ইবনে আসির বলেন, আরসালান উদার, মহানুভব, জ্ঞানী,ন্যায়পরায়ণ,ধার্মিক,দয়ালু ও পরোপকারী শাসক ছিলেন। তিনি মার্ভ থেকে সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্পাহানে স্থানন্তরিত করেন। অবশেষে তিনি ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত এক বিদ্রোহীর আতর্কিত আক্রমণে আহত হয়ে সেলজুকদের সিংহ মহান সুলতান আল্প আরসালান মৃত্যুবররণ করেন। সুলতান আল্প আরসালানের রাজত্বকালে ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া মানজিকার্দের যুদ্ধের গুরুত্ব ইসলামের ইতিহাসে অপরিসীম।
এই যুদ্ধের ফলে তুর্কি মুসলিমরা এশিয়া মাইনরে প্রাধন্য সুপ্রতিষ্টিত করতে সক্ষম হয়। এশিয়া মাইনরে তুর্কিকরণ ইসলামী রাজ্য এবং ধর্ম বিস্তারে সহায়কই ছিল না বরং পরবর্তীকালে উসমানীয় তুর্কিদের আবির্ভাব সুনিশ্চিত হয় এবং বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয়ের প্রথম পদক্ষেপ বলে মন করা হয়।
পরবর্তী পর্বটি পড়ুন : মানজিকার্ট যুদ্ধ : দুই লক্ষ খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করে চল্লিশ হাজারের মুসলিম বাহিনী
ভিডিও দেখুন:
তথ্যের উৎস:
- আরব জাতীর ইতিহাস - ড. লৎফর রহমান
- সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লবি
- ইসলামের ইতিহাস - ড. মাহমুবুর রহমান
- উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট
1 মন্তব্যসমূহ
গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ইতিহাস,,,, অধিকাংশ মুসলিম এগুলো জানেনা।
উত্তরমুছুন