মানজিকার্টের যুদ্ধ : যে বিজয়ের পথ ধরে আধুনিক তুরস্কের সূচনা |

                            

বায়জান্টাইন সাম্রাজ্য এবং সেলজুক সালতানাতের মাঝে ‘নো ওয়ার জোন’ হিসেবে বাফার স্টেট ছিল বর্তমান আর্মেনিয়ার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত বাগরাতিড সাম্রাজ্য। ১০৪৫ সালে বায়জান্টাইন সম্রাট দশম কনস্টান্টিন অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেন বাগরাতিড সাম্রাজ্য। বাগরাতিড সাম্রাজ্যের রাজধানী আনি’র দখল নেয়ার পর রোমান সম্রাট সেলজুকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।

আরও পড়ুন: সুলতান আল্প আরসালান : গর্জে ওঠা সেলজুক সিংহের বীরত্বগাঁথা

১০৬৩ সালে সেলজুক সালতানাতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সুলতান মুহাম্মাদ বিন চাগরী বেগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সালতানাতের সীমানা সুরক্ষিত রাখতে হলে হয়তো বাগরাতিড সাম্রাজ্য পুনস্থাপন করতে হবে, নতুবা রোমানদের তাড়িয়ে বাগরাতিড অঞ্চল বিজয় করতে হবে। ১০৬৪ সাল নাগাদ রোমানদের সাথে সেলজুকদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে এর পরের বছরই সুলতান মুহাম্মাদ আলপ আরসালান আক্রমণ চালিয়ে মাত্র ২৫ দিনের অবরোধে আনি দখল করে নেন৷

                                             

সুলতান আল্প আরসালান

সেলজুক ও রোমান দুই পক্ষই একমত হল, এইভাবে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চালালে দুই সাম্রাজ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যেহেতু রোমানরাই প্রথম বাফার স্টেটে আক্রমণ করে সীমান্তের স্থিতিশীল অবস্থা বিনষ্ট করেছিল, তাই সেলজুকদের আনি দখলের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করলো না। বরং শান্তিচুক্তির জন্য আবেদন জানালো তারা। অপরদিকে, সীমান্তের দুই প্রান্তে একইসাথে রোমান ও ফাতেমী, এই দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো কঠিন ছিলো সুলতান আলপ আরসালানের জন্য ৷ তাই রোমানদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করল সেলজুকরা।

                                             আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস      

১০৬৮ সালে নতুন রোমান সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন সম্রাট চতুর্থ রোমানোস। ক্ষমতায় এসেই তিনি সেলজুকদের সাথে করা চুক্তিকে বাতিল ঘোষণা করে সেলজুক সালতানাতের অধীন সিরিয়ায় আক্রমণ চালান এবং কিছু এলাকা দখল করে নেন। কিন্তু সুলতান মুহাম্মাদ দ্রুতগতিতে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে রোমান বাহিনীকে পরাজিত করেন। বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও সুলতান রোমানদের সাথে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দেন। সেলজুক ও রোমানরা আবারো শান্তিচুক্তির অধীনে যুদ্ধ বন্ধ রাখার অঙ্গীকার করে।

১০৭১ সালের বসন্তের শুরুতে সুলতানের কাছে সম্রাট রোমানোসের পক্ষ থেকে রোমান দূত শান্তিচুক্তির নবায়ন ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব আনলে সুলতান সম্মতি প্রদান করেন। সীমান্তের একদিক সুরক্ষিত করে সুলতান ফাতেমীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য আলেপ্পো অভিমুখে রওনা হলেন। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন রোমান সম্রাট। সুলতান আলেপ্পোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন শুনে রোমানোস তার বাহিনী নিয়ে বের হলেন সাবেক বাগরাতিড সাম্রাজ্যের তথা বর্তমান আর্মেনিয়ার রাজধানী “আনি“ সেলজুক যোদ্ধাদের হাত থেকে দখল করার জন্য।

রোমানোস তার বাহিনী নিয়ে আনির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সাথে সাথেই সেলজুক গোয়েন্দারা সুলতানের কাছে রোমানোসের যুদ্ধযাত্রার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করে। সুলতান আলেপ্পো না গিয়ে শান্তিচুক্তি ভঙ্গকারী রোমানোসের সাথে লড়াই করার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন রোমানদের বাহিনীর যাত্রাপথ অভিমুখে। রোমান সম্রাট রোমানোস প্রায় দুই লক্ষ যোদ্ধাকে সাথে নিয়ে সেলজুকদের নাম পুরোপুরি মুছে দেয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললেন ভ্যান হ্রদের দিকে, যা বর্তমান তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।

   আরও পড়ুন: সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান                                

তার উদ্দেশ্য ছিল ভ্যান হ্রদের উত্তর ও পশ্চিমে থাকা দুটি সেলজুক দুর্গ মানজিকার্দ ও আহলাত দখল করে সেলজুক সালতানাতে প্রবেশ করা। এই লক্ষ্যে নিজের সাথে থাকা প্রায় যোদ্ধাদের থেকে ত্রিশ হাজার যোদ্ধাকে জেনারেল জোসেফের অধীনে আহলাত অভিমুখে যাওয়ার নির্দেশ দেন রোমানোস। এই বাহিনীর ওপর দুটি দায়িত্ব দেওয়া ছিলো। এক, আহলাত দুর্গ দখল করা এবং দুই, আলেপ্পো থেকে ঘুরে যদি সুলতান বায়জান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাকে আহলাতের দক্ষিণ দিক থেকেই এগিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে তার যাত্রা রুখে দেওয়া।               

মানজিকার্দের প্রান্তর

কিন্তু তাদের জানা ছিলো না সুলতান ইতোমধ্যেই এই এলাকা অতিক্রম করে ভ্যান লেকের দক্ষিণ দিয়ে এই ত্রিশ হাজার যোদ্ধার পেছনে এসে পৌঁছে গেছেন প্রায়। জেনারেল জোসেফের সৈন্যরা সুলতান মুহাম্মাদের সৈন্যদের মোকাবেলা করার আশায় দক্ষিণে চেয়ে থাকলেও সুলতান আকস্মিক আক্রমণ করলেন জেনারেল জোসেফের বাহিনীর উত্তর দিক থেকে। অতর্কিত এই আক্রমণে জোসেফের বাহিনী দিশেহারা হয়ে গেল।

 তেমন বড় কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই সুলতান মুহাম্মাদ জেনারেল জোসেফের বাহিনীকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করলেন। এরমধ্যেই ২৩শে আগস্ট সম্রাট রোমানোস মানজিকার্দ দুর্গ দখল করে নেন ৷ আহলাতে তার বাহিনীর পরাজয়ের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখবর সম্রাট আহলাত দখলের উদ্দেশ্যে রওনা করেন মানজিকার্দ থেকে ৷ কিন্তু সুলতান মুহাম্মাদ তার দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে ভ্যান লেকের উত্তরে অবস্থিত পাহাড়ের আড়াল নিয়ে মানজিকার্দে এসে পৌঁছান। সম্রাট রোমানোস সুলতানের বাহিনীর দ্রুততার সামনে পরাস্ত হয়ে বাধ্য হলেন মানজিকার্দেই লড়াই করতে।

                  আরও পড়ুন:মুতার যুদ্ধ : ১ লক্ষ খ্রিস্টান বনাম ৩ হাজার মুসলিম সৈন্য                  

১০৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে আগস্ট দুপুরে দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করলে সুলতান মুহাম্মাদ সম্রাট রোমানোসের কাছে শান্তিপ্রস্তাব পাঠান। কিন্তু সুলতানের বাহিনীতে মাত্র চল্লিশ হাজার যোদ্ধা দেখে সংখ্যা ও অস্ত্রের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা সম্রাট রোমানোস শান্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবি হয়ে পড়ে। ২৬ আগস্ট ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সকালের আলো ফুটে উঠতেই দুই বাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো মালাজগির্দের ময়দানে।

যুদ্ধের শুরুতেই সর্বাত্মক হামলার আদেশ দিলেন রোমানোস। নিজে অগ্রসর হলেন মুসলিম বাহিনীর মধ্যভাগে সুলতান মুহাম্মাদ আলপ আরসালানের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য। ডান বাহুতে শাহজাদা সুলাইমানের ওপর হামলা চালালেন জেনারেল নিকেফোরাস। বাম বাহুতে জেনারেল আরতুক বেগের ওপর হামলা চালালেন জেনারেল থিওডর আলায়েতিস। মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে লাগল। বায়জান্টাইনরা বারবার প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো মুসলিম বাহিনীকে যে কোনো একটি জায়গায় জমিয়ে আক্রমণ করার জন্য।

কিন্তু মুসলিম যোদ্ধারা বায়জান্টাইন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় লড়ার বদলে পুরো প্রান্তর ঘুরিয়ে ছাড়ছিলো। প্রায় ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার ব্যাপী অঞ্চল নিয়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বিকালের কিছু পর বায়জান্টাইন বাহিনী সুলতানের তাঁবু দখল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু রোমানোস বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই তাঁবু সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে বেশিক্ষণ দখলে রাখা যাবে না। তাই নিজের যোদ্ধাদের নিজেদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেন তিনি।

যুদ্ধ

                                       
ঠিক এই সময় বায়জান্টাইন রিজার্ভ বাহিনীর অধিনায়ক অ্যান্ড্রোনিকাস ডুকাস বেঈমানী করলেন। তিনি সম্রাটের আদেশকে নিজের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করলেন। যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে নিজের অধীন সেনাদের নিয়ে চলে গেলেন তিনি। রিজার্ভ বাহিনীকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে দেখে সম্পূর্ণ খ্রিস্টান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আবারো দৃশ্যপটে হাজির সেলজুক গোয়েন্দারা। যুদ্ধের মাঠের এই বিশৃঙখল অবস্থার মাঝেই তারা মাঠের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছিল, সম্রাট রোমানোস মারা গেছেন। তাই রিজার্ভ বাহিনী মাঠ ছেড়ে চলে গেছে৷

সারাদিন ধরে মুসলিম ক্যাভালরি বাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে ছুটতে গিয়ে খ্রিস্টানদের প্রতিটি ইউনিটের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। তাই রোমানোসের সত্যিকার অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব ছিল না রোমানদের৷ এই অবস্থায় শাহজাদা সুলাইমানের সাথে একত্রিত হয়ে সুলতান আলপ আরসালানের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো জেনারেল নিকেফোরাসের বাহিনীর ওপর। ত্রিশ মিনিটেরও কম সময়ে জেনারেল নিকেফোরাসের বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

এই অবস্থায় খ্রিস্টান বাহিনীর ডান বাহু থেকে যোদ্ধারা দলে দলে যুদ্ধ ছেড়ে পালাতে লাগল। মাঠে রয়ে গেলেন শুধু সম্রাট রোমানোস এবং তার বিশ্বস্ত যোদ্ধারা । সেনাপতি আরতুক বে, শাহজাদা সুলাইমান এবং সুলতান মুহাম্মাদের বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের সামনে সম্রাটরে যোদ্ধারা বুক চিতিয়ে লড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না তারা। অনেকে পালালো, বাকিরা হয় আত্মসমর্পণ করলো নতুবা নিহত হলো সেলজুক যোদ্ধাদের হাতে। সেলজুকদের বিজয়ের নিশানা উড়ল মানজিকার্দের প্রাঙ্গনে। অবশেষে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম মুজাহিদের কাছে পরাজিত হল বিশাল বায়জান্টাইন সেনাবাহিনী

পরাজিত বায়জান্টাইন বাহিনী

                         আরও পড়ুন:উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস                                             

ইতিহাসে প্রথম ও শেষবারের মতো কোনো বায়জান্টাইন সম্রাট জীবিত বন্দী হলেন। এক সেলজুক যোদ্ধার আঘাতে তরবারি হারিয়ে বন্দীত্ব বরণ করলেন সম্রাট রোমানোস। শেষ বিকেলের আলোয় মাত্র দেড় ঘন্টার ব্যবধানে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া গল্প লেখা হল শহীদদের রক্তের কালিতে। চুক্তিভঙ্গকারী এবং সংখ্যাধিক্যে দাম্ভিক সম্রাট রোমানোসকে যখন সুলতানের সামনে আনা হলো, সুলতান তার সাথে সম্রাটসুলভ আচরণ করলেন। তাকে খাবার ও পানি দেয়া হলো। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বায়জান্টাইন সম্রাটকে মহান সুলতনা মুহাম্মাদ আলপ আরসালান ক্ষমা করেন।

ইসলামের বিজয় অভিযানের ইতিহাসে মানজিকার্দের যুদ্ধে বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। সুলতানের আলপ আরসালানের নেতৃত্বে মানজিকার্দের যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আনাতোলিয়ার মাটিতে মুসলমানদের স্থায়ীভাবে প্রবেশের পথ তৈরি হয়। এ বিজয়ের পথ ধরে মুসলমান বিশেষত তুর্কি মুসলমানরা জয় করে নেয় সমগ্র আনাতোলিয়া এবং ধীরে ধীরে বায়জান্টাইন খ্রিস্টান আনাতোলিয়া পরিণত হয় তুর্কি মুসলমান অধ্যুষিত আনাতোলিয়ায়। অবশেষে মানজিকার্দ সহ আরো বিভিন্ন বিজয়ে শহীদদের রক্তে যে আনাতোলিয়ার মাটি সজীব হয়েছে, সেই ভূখন্ডে প্রথমে তিন মহাদেশ বিস্তিৃত উসমানীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয় এবং আজ তুরস্ক নামে একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। 

পরবর্তী পর্বটি পড়ুন : সুলতান মালিক শাহ : সেলজুক সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান

           ভিডিও দেখুন:

                             

                   তথ্যের উৎস:

  • আরব জাতীর ইতিহাস - ড. লৎফর রহমান                  
  • সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লবি 
  • ইসলামের ইতিহাস - ড. মাহমুবুর রহমান
  • উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট

                        

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ