পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম আঃ এর মাধ্যমে ভূমন্ডলে ইসলাম ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। এরপর লক্ষ-কোটি বছর ফেরিয়ে যায়, শত-সহস্র সভ্যতার উত্থান-পতন হয়। হযরত আদম আঃ এর পর প্রায় আরও ২ লক্ষ ২৪ হাজার বা ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবী-রাসূল পৃথিবীতে প্রেরিত হয়। যুগে যুগে এই নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ বিভিন্ন জাতির কাছে ইসলামকে পৌছে দেন। তাদের মাঝে যারা সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমান তারা এই ধর্মের প্রতি অবিচল থাকে। সর্বশেষ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মাধ্যমে এই ধর্ম পূর্ণতা লাভ করে।
আরও পড়ুন: মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থা
তবে কোন শুভলগ্নে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন হয়, তা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। ইসলামের জ্যেতির ছটা কখন ভারত উপমহাদেশকে উদ্ভাসিত করেছিল তার সন-তারিখ ইতিহাসের পাতায় লিপিবব্ধ নেই। কারণ সর্বজনস্বীকৃত ভারতবর্ষে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলিম অভিযানের বহু পূর্ব হতে আরব সওদাগর ও ধর্মপ্রচারকদের আগমন ঘটেছিল। ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন সম্পর্কে ৩ টি ধারা পরিলক্ষিত হয়।
![]() |
সিন্ধু বিজয় |
প্রথমত, হযরত আদম আঃ বেহেশত হতে নির্বাসিত হয়ে প্রথম প্রদার্পন করেছিলেন ভূমন্ডলের ভারত ভূমিতেই। আর জায়গাটি ছিল সিংহল তথা শ্রীলঙ্খা, যেটা তখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলাম ধর্মের মতে, আল্লাহ প্রচুর পরিমাণে ফেরেশতা আছে, তাদের মধ্যে প্রথানতম হযরত জিবরাইল আঃ। তার পৃথিবীতে প্রথম পদধূলি পড়েছিল ভারতের মাটিতে। কারণ তার নবী হযরত আদম আঃ এর কাছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ পৌছাতে হত।
অন্যদিকে ভারতে অযোধ্যার এক বিরাট মন্দিরের পাশে সুদীর্ঘ এক কবর রয়েছে, এটা সম্বন্ধে যুগ যুগ ধরে জনশ্রুতি রয়েছে, এ সমাধি হযরত শীষ আঃ এর। তিনি ছিলেন হযরত আদম আঃ এর পুত্র। এর প্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারতবর্ষের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক সেই আদিকাল থেকেই রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে শেষ নবী মুহাম্মদ (স.) এর মাধ্যেমে ইসলামের পূণরুত্থান হয়। এ সময় সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত, ধর্মীয় অবস্থা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, রাজনৈতিক অবস্থা অরাজকতাপূর্ণ এবং সমাজব্যবস্থা ছিল বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথায় জর্জরিত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহানবী সাঃ এর জীবদ্দশায় ভারতে ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন হয়েছিল।
![]() |
প্রাচীন বাণিজ্য পথ |
তৎকালীন ভারতবর্ষের মাদ্রাজ তথা বর্তমান তামিলনাডু প্রদেশের একটি জেলার নাম মালাবার। এই মালাবারে ছিল একটি প্রসিদ্ধ সমুদ্র বন্দর, যা দিয়ে আরব বণিক ও ধর্মপ্রচারকরা মাদ্রাজ, মক্কা, হেযায, মিশর, শ্রীলঙ্খা ও চীনে যাতায়ত করতো। একদা মহানবী স. এর কিছু সাহাবী শ্রীলঙ্খায় অবস্থিত হযরত আদম আঃ এর স্মৃতি বিজড়িত পদচিহ্ন দেখতে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। যাত্রা পথে এই আরব তীর্থযাত্রিগণ মালাবার উপকূলে যাত্রা বিরতী করেন। এই সময় ‘চেরুমান পেরমল” নামক এক হিন্দু রাজার সাথে তাদের সাক্ষাত হয়।
আরও পড়ুন: মুহাম্মদ বিন কাসিম : প্রথম সিন্ধু বিজেতা মুসলিম বীর ।
কথা প্রসঙ্গে সাহাবীরা মহানবী স. এবং ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে হিন্দু রাজাকে অভিহিত করে। বিশেষ করে মহানবী স. কর্তৃক চন্দ্র বিভাজন কাহিনী বর্ণনা করেন। রাজা এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনায় বিশ্বাস করে ইসলাম গ্রহণ করেন। এমনকি সিংহল থেকে ফেরার সময় সাহাবীদের সাথে রাজা পেরুমল গোপনে তার সঙ্গি সাথীদের নিয়ে মুহাম্মদ স. এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য মক্কায় গমন করেন। মুহাম্মদ স, এর সাক্ষাত শেষে রাজা কিছুদিন আরবে থেকে দেশে ফিরে ইসলাম প্রচারে নিজেকে আত্মনিয়োগে ইচ্ছা পোষণ করেন।
কিন্তু হঠাত একদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার সঙ্গি শরফ বিন মালিক ও অন্যনাদের মালাবারে ইসলাম প্রচার করতে অনুরোধ করেন এবং এক পত্রে এই অনুরোধের কথা রাজ্যের প্রধানদের জানিয়ে দেন । আনুমানিক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজার মৃত্যুর পর শরফ বিন মালিক ও তার সঙ্গিগণ রাজার অনুরোদপত্র সঙ্গে নিয়ে যথাসময়ে মালাবারের ক্রেঙ্গানোনে এসে উপস্থিত হলে, রাজ্য প্রধানেরা তা সাদরে বরণ করেন।
রাজ্যপ্রধানগণ তাদের বসবাসের জন্য এক খন্ড ভূমি দান করেন এবং সেখানে তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটির নামকরণ করা হয়, চেরমান জুমা মসজিদ নামে। পরবর্তীতে রাজা পেরুমালের সঙ্গিদের মাধ্যমে এই ক্রেঙ্গান থেকে সমগ্র মালবারে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে সর্বপ্রথম রাজার সঙ্গী, মুসলিম বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে মালবার থেকে মাদ্রাজ এবং মাদ্রাজ থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে পড়ে। তাই ধারণা করা হয়, রাজা চেরুমান পেরমল হলেন প্রথম ভারতীয় মুসলিম।
![]() |
প্রাচীন আরব |
তৃতীয়ত, ৬২২ খ্রিস্টব্দে মদিনায় রাসূল (স.) সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে মুসলমানগণ পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের স্পেন,পুর্তুগাল এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল বিজয় করে ইসলামী বাণী ছড়িয়ে দেয় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এরি ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন কারণ ও ঘটনার পরিপেক্ষিতে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়স্ক তরুণ মুসলিম বীরের মাধ্যমে ভারতবর্ষের সিন্ধু, মুলতান সহ বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
এর মাধ্যমে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ইসলামের আগমন ঘটে। তাই বলা যায়, ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযানের মাধ্যমেই প্রথম ইসলামের আগমন হয় নি, বরং ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী, মুসলিম বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের সৎচরিত্র ও ভ্রাতৃবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভারতবাসী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
আরও পড়ুন: মুসলমানদরে সিন্ধু বিজয়
- ভারতবর্ষের ইতিহাস (মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসন)- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাছান।
- ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস - এ.কে,এম আব্দুল আলীম।
- ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস - এ.কে.এম শাহানেওয়াজ।
- ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস - মাহমুবুর রহমান।
- ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস- ড. মুহাম্মদ গোলাম রসূল।
- উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
0 মন্তব্যসমূহ