পূর্বের অংশ পড়ুন : ওরগুজ খান ও ওরগোজ তুর্কিদের অজানা ইতিহাস ।
ইসলামের ইতিহাসে এবং খিলাফতে সেলজুক তুর্কিদের উত্থান একটি নতুন ও বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূচনা করে। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেলজুক তুর্কি শক্তির অভ্যুথান ঘটে। মুসলিম বিশ্ব এসময়ে নানান রকম আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের শৈার্যবীর্য ক্ষয় হচ্ছিল। এসময় মুসলিম বিশ্ব ছিল ক্ষুদ্র-খণ্ড স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত। এই রাজ্যসমূহের মধ্যে একমাত্র মিশরের ফাতেমি সাম্রাজ্য ছাড়া অন্য কোন উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল না। কিন্তু ফাতেমিগণ বাতিল শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল বলে সুন্নীদের সাথে তাদের শত্রুতা বিদ্যমান ছিল।
![]() |
আব্বাসীয় ম্যাপ |
স্পেন ও উত্তর-আফ্রিকা ইতোপূর্বেই বাগদাদের খলিফাদের হাতছাড়া হয়ে পড়ে। তাছাড়া সিরিয়া, ইরাক ও পারস্যের অবস্থাও বলতে গেলে একইরকম। তাই এ অবস্থায় সেলজুক শক্তির উত্থান নিঃসন্দেহে বিশ্বের মুসলিমদের ভাগ্যের দরজা খুলে দেয়। তাদের প্রচেষ্টায় আব্বাসীয় সুন্নী খিলাফতের লুপ্ত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তারা রাজ্য বিস্তার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আফগানিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত সেলজুক শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
আরও পড়ুন: রুমের সেলজুক সালতানাতের ইতিহাস
সেলজুক তুর্কিরা বাইজান্টাইনদের থেকে অনেক অঞ্চল অধিকার করেছিল আর ক্রুসেডারদেরকেও তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহত করেছিল। এদের এই অবদানের কারণেই পরবর্তীতে আরেক তুর্কি বংশ উসমানীয়রা ইউরোপ ও এশিয়া মাইনোরে সাফল্যের সাথে অদূর ভবিষ্যতেই তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেলজুক তুর্কিগণ সুদূর আনাতোলিয়া পর্যন্ত তাদের অধীনে আনয়ন করতে সক্ষম হয়।
আনাতোলিয়া ছিল বহু প্রাচীন জাতি ও সভ্যতার আদিভূমি এবং তিনটি মহাদেশের মিলনক্ষেত্র। তাই এই অঞ্চলে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মধ্য-এশিয়ার তুর্কিরা নয়টি প্রধান গোত্রে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে সেলজুকরা ছিল ওঘুজ তুর্কিদের একটি অন্যতম শাখা। ওঘুজ দলপতিকে ‘ইয়াবঘু’ বলা হতো। এরা ছিল মূলত তুর্কিস্তানের অধিবাসী। ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ওঘুজ তুর্কিরা তাদের দলপতি সেলজুক ইবন্ ইয়াকুবের নেতৃত্বে জন্মভূমি তুর্কীস্তানের কিরঘিজ উপত্যাকা পরিত্যাগ করে দক্ষিণ ট্রান্স অক্সিয়ানার বোখারা প্রদেশের জাল নামক স্থানে বসবাস শুরু করে।
![]() |
বুখারা ম্যাপ |
কথিত আছে যে, ওঘুজ দলপতি সেলজুক সর্বপ্রথম সদলবলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।দলপতি সেলজুকের নাম অনুসারে এই গোত্র ইতিহাসে সেলজুক বংশ বলে পরিচিত হয়। সেলজুকগণ অতঃপর গজনভি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবু মনসুর শবুক্তগিনের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে এবং অবিলম্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গজনীর পরবর্তী শাসনকর্তা সুলতান মাহমুদ গজনবী সেলজুকদের এই শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে তাদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতেন।
অবশেষে তিনি সেলজুক তুর্কিদের একটি দলকে তাদের দলপতি সেলজুকের অধীনে খোরাসানে নির্বাসিত করেন। সুলতান মাহমুদ কর্তৃক সেলজুকদেরকে খোরাসানে বহিষ্কার প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য শাপে বর স্বরূপ হয়েছিল, কেননা অদূরভবিষ্যতে খোরাসানকে কেন্দ্র করেই সেলজুকদের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেলজুক বেগের মৃত্যুর পর সেলজুক দলপতির ভার নেন তার পুত্র মিকাইল ইবনে সেলজুক বেগ।
তিনিও প্রথম দিকে তার পিতার মতো অমুসলিম ছিলেন। এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মিকাইল ইবনে সেলজুক ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মিকাইলের মৃত্যুর পর তুর্কিগণ তার পুত্র ও সেলজুক বেগের পৌত্র তুগ্রীল বেগকে দলপতি নির্বাচন করেন। তিনি সুলতান মাহমুদ গজনবীর দুর্বল উত্তরাধিকারী মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে হিরাটের নিকট যুদ্ধে জয় লাভ করেন।
![]() |
সুলতান তুঘ্রীল বেগ |
গজনী সুলতান মাসুদের রজত্বে গজনী বংশের দ্রুত অবনতি হয় এবং সেলজুকদের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বস্তুত তুঘ্রিল বেগের যোগ্য নেতৃত্ব ও সমর প্রতিভার ফলেই সেলজুকরা একটি রাজশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া তিনি ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান। তাই সেলজুকের পৌত্র তুঘ্রীল বেগকে সেলজুক বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
পরবর্তী পর্ব পড়ুন : তুঘ্রিল বেগ : মুসলিম খেলাফতের রক্ষক !! ইসলামী খেলাফতের ইতিহাস |
ভিডিও দেখুন:
তথ্যের উৎস:
- আরব জাতীর ইতিহাস - ড. লৎফর রহমান
- সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লবি
- ইসলামের ইতিহাস - ড. মাহমুবুর রহমান
- উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট
0 মন্তব্যসমূহ