পুকুরে বড় বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলা হয় “ মাৎস্যন্যায়। বাংলায় এই সময় সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করেছিল। প্রাচীন বাংলার শত বছরের রাজনৈতিক শূন্যতা ও অরাজকতাপূর্ণ সময় 'মাৎস্যন্যায়' যুগ পেরিয়ে জনজীবনে একপ্রকার স্বস্তি এনেছিল এই পাল শাসন। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে পাল রাজত্বের উত্থান ঘটে।
আরও পড়ুন:বাংলায় গুপ্ত শাসনের উত্থান পতন
পাল বংশের প্রথম রাজা ছিলেন ব্যাপটের পুত্র গোপাল। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় পাল বংশের রাজত্বকালে। পাল বংশের রাজারা একটানা চারশত বছর বাংলা শাসন করেছিল। এত দীর্ঘ সময় এ দেশ আর কোন রাজবংশ শাসন করেনি। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। তার যুগে তিনটি রাজবংশ যুদ্ধে নেমেছিল উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে। একটি বাংলার পাল বংশ, অন্যটি রাজপুতনার গুর্জার প্রতিহার বংশ এবং তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ। ইতিহাসে এই রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ ত্রিশক্তির সংঘর্ষ নামে পরিচিত।
বর্তমান বাংলা ও বিহার অঞ্চলের একটি অংশে গোপাল যে সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন, ধর্মপাল তাকে শক্তিশালী কাঠামোর উপর দাঁড় করান। তিনি গৌড়, মগধ এবং উত্তর ভারতের অংশবিশেষের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক রাজবংশকে উত্তর ভারতের বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্মপাল আনুমানিক চল্লিশ বছর ক্ষমতায় আসীন থেকে ৮১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন।
ধর্মপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র দেবপাল পাল সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। দেবপালের শাসনামলও পাল শাসনের সুবর্ণ সময় ছিল। তিনি তার পিতার রাজ্যসীমা আরো বৃ্দ্ধি করে পাল সাম্রাজ্যকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেবপাল পাল সাম্রাজ্যের সীমা উত্তর পশ্চিমে কম্বোজ ও দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি আসাম ও উড়িষ্যা অভিযানেও সাফল্য লাভ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:প্রাচীন বাংলার জনপদসমূহ
আনুমানিক ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল মৃত্যুবরণ
করার মাধ্যমেই মূলত পাল শাসনের অগ্রগতি স্থবির হয়ে যায়। এ অবস্থানে আর কখনো ফিরতে
পারেনি পালরা। এরপর পাল সাম্রাজ্য পতনের দিকে যেতে থাকে। দেপালের পর সিন্ধু নদীর
জল গড়িয়েছে অনেক দূর। অতঃপর ৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে পালদের রাজা হলেন প্রথম মহিপাল, মহীপাল তার পূর্বসূরীদের হারানো সীমানার কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন। কম্বোজদের হাত থেকে পালদের পুরনো পিতৃভূমিও অধিকার করে পালদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাই তাকে পাল
সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
প্রথম মহিপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র নয়াপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। নয়াপালের মৃত্যুর পর তৃতীয় বিগ্রহ পাল এবং তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মহিপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন ১০৭৫ সালে। দ্বিতীয় মহিপালের রাজত্বকারে প্রধান ঘটনা বরেন্দ্রর সামন্ত বিদ্রোহ। এর ফলে কৈবর্ত তথা জেলে সম্প্রদায়ের নায়ক দিব্য দ্বিতীয় মহিপালকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে বরেন্দ্র অধিকার এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
আরও পড়ুন : বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি ও গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের উত্থান-পতন ।
দ্বিতীয় মহীপালের পতনের পর পালদের হাল ধরেন শুরপাল। আর শুরপালের পর পালদের আকাশে আরো একটু আলো ছড়িয়েছিলেন রামপাল। অপরদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে দিব্যের পর রুদ্রোক এবং তারপর ক্ষমতা গ্রহণ করেন ভীম। রুদ্রোক এবং ভীম দুজনই সুশাসক ছিলেন। তাদের জনপ্রিয়তায় রামপাল শংকিত হয়ে পড়েন এবং তিনি আরো কয়েকজন সামন্তরাজার সাহায্য নিয়ে ভীমকে আক্রমণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধে ভীম বন্দী হলে রামপাল তাকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করেন। ভীমের মৃত্যুতে বরেন্দ্র অঞ্চল আবার পালদের অধীনে আসে। রামপাল বাংলা অঞ্চলের অধিকাংশ স্থান পুনরুদ্ধারসহ উড়িষ্যা, কামরুপেও আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন
প্রায় চারশ' বছর আগে একজন গোপালের রাজা নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে যে পাল বংশের উত্থান, তার প্রায় চারশত বছর পর সেই পাল বংশের শাসনের চূড়ান্ত পতন ধারা পৌঁছেছিল আরেকজন গোপাল পর্যন্ত। তিনি পাল রাজা চতুর্থ গোপাল। ধারণা করা হয়, শত্রুর হাতে নিহত হয়েছিলেন তিনি। তার পরবর্তী শাসকের সময়ই পাল সাম্রাজ্য চূড়ান্ত
রুপে পতন। এসময় যিনি পালদের সিংহাসনে ছিলেন তিনি হলেন পাল বংশের শেষ শাসক মদনপাল। ১১৬১ সালে
মদনপাললের শাসনকালে পাল সাম্রাজ্যর চূড়ান্ত পতন ঘটে। এবং পালদের পতনের মাধ্যমে বাংলা অঞ্চলে সেন বংশের শাসনের সূচনা ঘটে।রামপালের হত্যাকান্ড
0 মন্তব্যসমূহ