মুহাম্মদ বিন কাসিম কে ছিলেন? প্রথম সিন্ধু বিজেতা মুসলিম বীরের ইতিহাস।

                                                             

হযরত মুহাম্মদ স. এর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব দেশ ইসলামের দীপ্ত আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে। তাঁর জীবদ্দশায় আরবের দূরবর্তী অঞ্চল গুলোয় ইসলামের প্রচার ও প্রসার না হলে তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধীকারীগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বিজয় পতাকা বহন করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। খ্রিস্টীয় অষ্‌টম শতকের শুরুতেই ইসলাম ইউরোপের সমগ্র স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, ও পশ্চিম এশিয়া পর‌্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

আরও পড়ুন : ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন, প্রথম মুসলিম ও মসজিদ ।

রাশেদুনের খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা ওমর রাঃ এর খেলাফতের সময় মুসলমানগণ প্রথম ভারত বিজয়ের চেষ্টা করে, কিন্তু বিপদ ও নানা অসুবিধার জন্য তখন অভিযান সাফল্যের মুখ দেখেনি। এর পর রাশেদুনের খিলাফতের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর যুগে ইরান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চল ‘মেকরান’ মুসলিম শাসনভুক্ত হয়। অতপর উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ নতুন করে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন।                                     

তাঁর শাসনামলে স্পেন, পর্তুগাল, চীনের কাশগর এবং ভারতবর্ষের সিন্ধু অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের এই ঐতিহাসিক বিজয়াভিযানের নেতৃত্ব দেন মাত্র্র ১৭ বছর বয়সি কিশোর সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম। মূলত তাঁর মাধ্যমেই ভারতবর্ষে ইসলামী শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয                                             

মুহাম্মদ বিন কাসিম

মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্ণ নাম ইমাদউদ্দিন মুহাম্মদ বিন কাসিম আল সাকাফি। তিনি ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের একজন সুযোগ্য সেনাপতি। সিন্ধু নদসহ সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল তিনি জয় করে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তার সিন্ধু জয়ের কারণে মুসলিমদের পক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশ বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭২ হিজরি মোতাবেক ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের তায়েফে শহরের বিখ্যাত বনু সাকাফি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা মুহাম্মদ বিন হাকাম সাকাফি গোত্রের প্রধান ছিলেন। তাঁর পিতার নাম কাসিম বিন হাকাম।  উল্লেখ্য, আনুমানিক ৬৩০ সালে ইসলাম গ্রহণের পর সাকাফি গোত্রের সদস্যরা ধীরে ধীরে খিলাফতের উচ্চ সামরিক ও প্রশাসনিক পদমর‌্যদা অর্জন করে।

আরও পড়ুন: ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন।

বিশেষ করে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের আবির্ভাবের সাথে সাথে এই গোত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের পিতা মুহাম্মদ বিন হাকামের চাচাতো ভাই ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তার উত্থানের সাথে সাথে সাকাফি গোত্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাই। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া খলিফা আব্দ আল মালিকের শাসন আমলে অন্যতম একজন সেনাপতি ছিলেন।             

উমাইয়া খিলাফত

 ৬৯৪ সালে তিনি ইরাক ও পূর্বঞ্চলের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তার পদোন্নতির পর আল হাজ্জাজ সাকিফ গোত্র ও তায়িফের ‍পৃষ্টপোষক হয়ে উঠেন। এর ফলে ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের আত্মীয় স্বজনদের থেকে বেশ কয়েকজন সদস্য নিযুক্ত করেন। এই প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পিতা কাসিম বিন হাকামকে বসরার ও অপর ভাই মুহাম্মদ বিন হাকামকে ইয়ামেনের ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত করেন। পিতার সঙ্গে মুহাম্মদ বিন কাসিম বসরায় আগমন করেন এবং এখানেই বেড়ে উঠেন। কিন্তু শৈশব না পেরোতেই পিতাকে হারান তিনি।

পিতার মৃত্যুর পর মায়ের যত্নে বড় হতে থাকেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। তাছাড়া মুহাম্মদ বিন কাসিম তার চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফেরও খুব প্রিয় ছিল। হাজ্জাজ তাকে যুদ্ধবিদ্যা ও প্রশাসন পরিচালনা শিক্ষা দেন। সিন্ধু অভিযানের পূর্বে মুহাম্মদ তার চাচাতো বোন ও হাজ্জাজের কন্যা জুবাইদাকে বিয়ে করেন। এমনকি হাজ্জাজের পৃষ্ঠপোষকতায় খুব অল্প বয়সেই মুহাম্মদ পারস্যের খোরাসান অঞ্চলের গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। এবং সেখানে তিনি একটি বিদ্রোহ দমন করতে সফল হন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সিন্ধু ও মুলতান বিজয় । বিভিন্ন কারণ ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে তিনি ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের সিন্ধু অঞ্চল ও মুলতান বিজয় করে উমাইয়া খেলাফতের অন্তুর্ভুক্ত করেন। ৭১৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে উমাইয়া খেলাফতের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত মুহাম্মদ বিন কাসিম পূর্ণ আনুগত্য, নিষ্ঠা ও ইনসাফের নজীর স্থাপন করে গেছেন মুসলিম খেলাফতের পূর্ব সীমান্তে।            

সিন্ধু ম্যাপ

সিন্ধু বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম তার উন্নত চরিত্রের গুণে, যুদ্ধে ও শাসন পদ্ধতির কৃতকার‌্যতার মহিমায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম শুধু রণ-নীতি বিশারদ, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী সেনাপতিই ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত সহৃদয়, বহুমুখী প্রতিভাশালী সুশাসক ও ছিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের অল্প বয়সে অদম্য সাহস, মহান বীরত্ব,যুদ্ধক্ষেত্রে অপূর্ব সমর কৌশলের কারণে তাকে মুসলিম ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তার সুনিপুণ শাসন-পদ্ধতি ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের জন্য তিনি অমুসলিম সিন্ধু বাসীর কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন। এমনকি তার সৎচরিত্র ও মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার ভারতীয় হিন্দু ইসলামের শান্তির নীড়ে আশ্রয় নেয়।

আরও পড়ুন মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের বীরগাথা ইতিহাস |

তথ্যসূত্র :

  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসন)- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাছান।
  • ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস - এ.কে,এম আব্দুল আলীম। 
  • ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস - এ.কে.এম শাহানেওয়াজ।
  • ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস - মাহমুবুর রহমান।
  • ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস- ড. মুহাম্মদ গোলাম রসূল।
  • উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ