উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ইসলামী সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নব-যুগের সূচনা হয়। মদিনায় মহানবী স. এর হিজরতের একশত বছরের মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে পূর্বে পারশ্য পর্যন্ত ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি লাভ করে। উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বকালে একদিকে স্পেন ও অপরদিকে সিন্ধু অঞ্চল ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। খলিফা ওয়ালিদের পূর্বাঞ্চলিয় প্রদেশের সুযোগ্য শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু বিজয় করেন।
আরও পড়ুন : সিন্ধু বিজয়ী মুসলিম বীর সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিচয় ।
সিন্ধু বিজয় ইসলামের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। সিন্ধু বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানের জন্য মুসলমানদের পথ খুলে দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হতো উপমহাদেশের 'বাবুল ইসলাম' বা ইসলামের প্রবেশপথ। মুসলমানদের সিন্ধু অভিযানের বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, পারশ্যে অভিযানকালে হিন্দু রাজারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারশ্য বাহনীকে সাহায্য প্রদান করে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম বিদ্রোহীদের রাজা দাহিরের আশ্রয় প্রদান করে।
তৃতীয়ত, পারশ্য বিজয়ের পর মুসলমানরা মাকরান তথা বেলুচিস্তান জয় করলে ইসলামী খেলাফতের সীমানা হিন্দু রাজা দাহিরের সিন্ধু রাজ্যের অতি সন্নিকটে চলে আসে। সিন্ধু রাজ মুসলমানদের ক্রমাগত বিজয়কে ভালো চোখে দেখতে পারেনি। চতুর্থত, সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ হলো- সিন্ধু রাজা দাহিরের সমুদ্র বন্দর দেবলের নিকটে সিন্ধু সৈন্য ও জলদস্যু কর্তৃক আটটি আরব জাহাজ লুন্ঠন, মুসলিম বন্দিদের নির্যাতন এবং নারীদের ধর্ষণ।
![]() |
সিন্ধু ম্যাপ |
উল্লেখ্য, সেই সময়ে সিংহলে আরব বণিকগণ বসবাস করতো এবং তাদের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুতে সিংহল রাজ তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ অসংখ্য মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে আটটি জাহাজ খলিফা ওয়ালিদ এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট পাঠান। কিন্তু জাহাজগুলো সিংহল থেকে সিন্ধুর দেবল বন্দরে পৌছালে দেবলের সৈন্য ও জল-দস্যুরা নৌবহরে আক্রমণ চালায়।
যাত্রীদের মারধর করে জাহাজের ধনরত্ন লুট করে। এমনকি আরব নারী-শিশুদেরকেও বন্দি করে। এতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরের নিকট জলদস্যুদের উপযুক্ত শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণের দাবী জানান। কিন্তু রাজা দাহির নাটকীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার জানায় এবং জলদস্যুদের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই ও তাদের শাস্তি দানে অক্ষম বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন: মুসলিম বিজয় পূর্ব ভারতের অবস্থা
অতপর এতে ক্রুদ্ধ হয়ে দাহিরকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য হাজ্জাজ প্রথমে ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ সহ অনেক মুসলিম সৈন্য রাজা দাহিরের বাহিনীর হাতে যুদ্ধে শহীদ হন। এরপর বোদাইলের নেতৃত্বে সিন্ধুতে দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি ও তার সৈন্যবাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে আবারও পরাজিত হয়। হাজ্জাজ এই দু:সংবাদ পেয়ে খুবই ব্যথিত হন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দু’বার ব্যর্থ হয়েও হাল ছেড়ে দেন নি। সিন্ধু রাজা দাহিরের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি তার স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে তৃতীয় অভিযানের সেনাপতি করে সিন্ধু প্রেরণ করেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। সর্বসাকুল্যে তিনি ১২ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করেন। এর মধ্যে ৬ হাজার ছিল অশ্বারোহী, ৩ হাজার পদাতিক এবং বাকি ৩ হাজার রসদবাহী উটের সাথে ছিল। এদিকে এই খবর রাজা দাহির আগেই পেয়ে যান। তার প্রায় ৭০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য তখন দেবল দুর্গ পাহারারত ছিল।
৭১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মুহাম্মদ বিন কাসিম রায় ও শিরাজ হয়ে মাকরানে পৌঁছালেন। মাকরান থেকে তিনি দাহিরের সমুদ্র দেবলে পৌছান। প্রথমেই তিনি দেবল দুর্গ অবরোধ করলেন। কয়েক মাস অবরোধ করে রাখার পর দেবল দুর্গ মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। রাজা দাহির তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন রাওয়ার দুর্গে। এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিম মাত্র ৪ হাজার সৈন্য দেবলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যান।
![]() |
মাকরান ম্যাপ |
আরও পড়ুন: ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন
স্থানীয় সৈন্যদের সাহায্যে প্রায় বিনাযুদ্ধে বহু এলাকা জয় করতে থাকেন তিনি। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের দাপটে ধুলা উড়িয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে। রাওয়ারে পৌঁছানোর পূর্বেই দাহির তার ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অগ্রযাত্রা রোধ করতে আসেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। এসময় তার বাহিনীতে রাজা দাহিরের চেয়ে সৈন্যসংখ্যা অনেক কম ছিল। সিন্ধু নদী অতিক্রম করে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বাহিনী নিয়ে রাওয়ার দুর্গ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তাঁবু খাটান।
সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েকদিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হন। ৭১২ সালের ১২ জুন মুহাম্মদ বিন কাসিম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। দাহিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রানী বাঈ এবং তার পুত্র জয়সিংহ প্রায় ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে অবস্থান নেন রাওয়ার দুর্গের ভেতরে। কিন্তু মুসলমানদের আক্রমণের মুখে রাওয়ার দুর্গের পতন ঘটে। রাওয়ার দুর্গ জয়ের মাধ্যমে সমগ্র সিন্ধু মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধীনে চলে আসে। ইসলামের বিজয় পতাকা ভারত-ভূমিতে উত্তোলিত হয়।
![]() |
কাসিমের বিজিত অঞ্চল সমূহ |
কয়েক মাসব্যাপী চলা এই অভিযানে দেবল ও রাওয়ার দুর্গ জয়ের মাঝখানে তিনি আরও কয়েকটি শহর জয় করেন, যেমন- ব্রাহ্মণ্যবাদ, বধু, নিরুন, আলোর এবং মুলতান ইত্যাদি। সর্বশেষ ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে মুলতান বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও মুলতান বিজয়ের পর তিনি তার সুযোগ্য সেনাপতি আবু হাকিমকে কনৌজ অভিযানের নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু অভিযান আরম্ভ করার পূর্বেই নব নির্বাচিত উমাইয়া খলিফা সুলাইমানের নির্দেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজধানী দামেস্কে প্রত্যাবর্তন করেন। এবং এখানেই ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২১ বছর বয়সে এই মহান বীরের জীবনবসান হয়।
আরও পড়ুন : ভারতবর্ষে আরব মুসলিম খেলাফতের পতন ! তুর্কি শাসনের উত্থান |
তথ্যসূত্র :
- ভারতবর্ষের ইতিহাস (মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসন)- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাছান।
- ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস - এ.কে,এম আব্দুল আলীম।
- ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস - এ.কে.এম শাহানেওয়াজ।
- ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস - মাহমুবুর রহমান।
- ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস- ড. মুহাম্মদ গোলাম রসূল।
- উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
0 মন্তব্যসমূহ