মদিনা হিজরত : মহানবীর (স.) মক্কা জীবনের অবসান এবং মদীনা জীবনের সূচনা |

                         

পূর্বের অংশ পড়ুন : আকাবার শপথ: মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর ।

৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজ্জের মৌসুমে ইয়াসরিব তথা মদীনাবাসীদের আকবার শপথ গ্রহণের ফলে মদিনায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাছাড়া মুসলমানদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন শুরু হলে মহানবীর স. নির্দেশে মক্কার মুসলমানরাও দলে দলে মদীনায় যেতে থাকে। আবিসিনিয়া থেকে আগত ২০০ মুসলমানকে মহানবী স. মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু অত্যাচার ও নিপিড়ন সত্ত্বেও মহানবী স. প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ না করে হযরত আলী ও আবু বকর রাঃ এর সাথে মক্কায় থেকে যান।

অন্যদিকে বিভিন্ন অত্যাচার-অনাচার, গালি-কুৎসা, কৌশল প্রয়োগ সত্ত্বেও মক্কায় ইসলামের গতি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাছাড়া মদিনার মুসলমানদের গমনেও তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনকি তারা ভাবতে থাকে যে, হয়তু একদিন মুসলমানরা মদীনায় গিয়ে শক্তিবৃদ্ধি করে মক্কা বিজয় করবে! মক্কার কাফেররা ঠিকই ইসলামের বিজয় ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু তবও তারা এই মহা সত্য ইসলামকে গ্রহণ করার পক্ষে ছিল না।

আভিজাত্যের গর্ভ, পূর্বপুরুষদের ধর্ম তাদের মন ও বিবেককে কূলষিত করে রেখেছিল।তাই তারা সত্যকে গ্রহণ না করে প্রতিরোধ করার চেষ্টায় ছিল। অবশেষে আরবের বুকে ইসলাম ও মুসলমানদের উত্থান ঠেকাতে এবার তারা নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিল মহানবী স. কে হত্যা করে ইসলামের গতিপথ বন্ধ করবে। এই উদ্দেশ্যে মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ মক্কায় দারুল নাদওয়া নামক পরামর্শ কক্ষে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্তে নিল।

                                                       

মহানবী স. কে হত্যার দায়ভার একক কোন গোত্রের উপর যেন না পড়ে, এ জন্য তারা সকল গোত্রের যোদ্ধাদের সমন্বয়ে মহানবী স. কে হত্যা সংঘ গড়ে তুলবে। তারা আরও সিদ্ধান্ত নিল, রাতে গৃহ ঘিরে রেখে সকালে মহানবী স. কে হত্যা করবে। কিন্তু যে মহামানবের উপর স্বয়ং মহান আল্লাহর রহমতের ছায়া রয়েছে,তাকে হত্যা করার শক্তি ‍সৃষ্টি জগতের মাঝে কার আছে?

অতপর মহানবী স. হযরত জীবরাইল আ: এর ওহীর মাধ্যমে মক্কার দারুল নদওয়ার বৈঠক ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত হন। এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে মহান আল্লাহর নিকট বিস্তারিত নির্দেশনা পান। হিজরত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা অত্যাচারিত হয়ে আল্লাহর পথে হিজরত করে, আমি তাদের দুনিয়ায় উত্তম ঠিকানা দান করব। আর আখেরাতের পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ।’ সূরা নাহল, আয়াত ৪১।

ইতিপূর্বে মহানবী স. মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করতে না চাইলেও ইসলামের স্বার্থে এবং মহান আল্লাহর আদেশে তিনি মদিনায় হিজরত করতে মনোস্থির করলেন। এরপর মহানবী স. আবু বকর রাঃ এর গৃহে গিয়ে তাকে বিস্তারিত অবগত করেন। অতপর মক্কার কাফের হত্যাসংঘ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি মহানবীর স. গৃহ ঘিরে রাখে।

                                                           

মহানবী স. মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে আলী রা: কে তার বিছানায় ঘুমানোর এবং গচ্ছিত আমানত ফেরত দানের নির্দেশ দেন। তিনি হযরত আবু বকর রা: কে সাথে নিয়ে মক্কার গুপ্ত হত্যা সংঘের চোখে ধূলা দিয়ে মহান আল্লাহর সাহায্যে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মক্কা হতে ২৫০ মাইল দূরে মদীনার উদ্দেশ্যে রাওনা দেন। মক্কার কাফেররা জানতে পারলে তারা মহানবীর (স.) পিছু নেয়। মহানবী (স.) ও আবু বকর রাঃ সেদিনের মত ছওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন এবং সেখানে তিন দিন অতিবাহিত করেন।

গুহায় অবস্থান কালে আবু বকর রাঃ এর পুত্র আব্দুল্লাহ ও কন্যা আসমা তাদের খাদ্য, পানিয় ও খবারখবর সরবারহ করতেন। এভাবে সওর গুহায় ৩ দিন অবস্থান করার পর মদিনার উদ্দেশ্যে আবার রাওনা দেন। মদিনা থেকে ৩ মাইল দূরে কুবা শহরে মহানবী স. তিন দিন অবস্থান করেন এবং কুবা বাসীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা করেন। পরে আলী রাঃ এখানে মহানবী (স.) এর সঙ্গে যোগ দেন। কুবায় জুমাআর নামাযের সময় হলে জামাতের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা ইতিহাসে মুসলমানদের প্রথম মসজিদ নামে পরিচতি।

পথিমধ্যে জুমার সালাত শেষে মহানবী স. মদীনার পথে রওনা দেন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর মদিনায় পৌছান। পৌছানোর পর মক্কা থেকে আগত মুসলমান এবং মদীনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা মহানবীকে (স.) সসম্মানে বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই ঘটনাকে হিজরত বলে এবং এই তারিখ থেকে হিজরী সালের গণনা শুরু হয়। অবশ্যয় ওমর রাঃ এর খেলাফতকালে হিজরির সন প্রবর্তিত হয়।

                                                         

মহানবী স. এর জীবনে হিজরতের তাৎপর‌্য প্রচুর। তিনি মক্কায় হয়েছিলেন নিপীড়িত, অত্যাচারিত এবং আতঙ্খিত কিন্তু তিনি মদিনায় লাভ করেন মহামান্য অতিথির স্থানে নিরাপদ আশ্রয় এবং হয়েছিলেন শঙ্খামুক্ত। তিনি মক্কায় ছিলেন কুরাইশদের চোখের বালি আর মদিনায় হলেন জনতার মুকুট মণি এবং সম্মানিত নেতা। মক্কায় তিনি পদে পদে বাধা পেতেন আর মদিনায় নির্বিঘ্নে তিনি ইসলাম প্রচার করতে পারতেন। তাছাড়া মহানবী স. এর মদীনায় হিজরত করার ফলে মদিনা শহরের মান মর‌্যদা গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। আউস ও খাজরাজ গোত্র তাঁকে শান্তির দূত হিসেবে লাভ করে।

তারা হযরত মুহাম্মদ স. এর সম্মানার্থে ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে এর নাম করেন মদিনাতুন্নবী বা সংক্ষেপে মদিনা। বস্তুত মদিনায় মহানবী স. এর হিজরতের ফলে হযরত মুহাম্মদ স. ও ইসলামের ইতহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। হিজরতের ফলে মহান আল্লাহর গুরু দায়িত্ব হযরত মুহাম্মদ স. মদিনায় পূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ লাভ করেন। হিজরতের সাথে সাথে মক্কা জীবনের সমাপ্তি এবং মদীনা জীবনের সূচনা হয় এবং মহানবী স. এর জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে।

 পরবর্তী অংশ পড়ুন : মহানবীর (স) আগমনকালে মদীনার অবস্থা |


তথ্যের উৎস সমূহ:

১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান 
৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট ।
                                 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ