পাপ-পঙি্কিলে নিমজ্জিত, হিংসা-বিদ্বেষ, বিবাদ-বিসংবাদ, কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতায় জড়িত পথভ্রষ্ট আরব ও মানবজাতিকে ন্যায় ও সত্যের পথ প্রদর্শনের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আবির্ভাব হয়। বাল্যকাল হতে তিনি আরবদের উচ্ছৃঙ্খলতা, পাশবিক প্রবৃত্তি ও অহেতুক রক্তপাতে ব্যথিত হয়ে পড়েন। আরব জাতীর এই দূরবস্থা দেখে মহানবী (স.) এর মন খুবই ব্যাথিত হত। অতঃপর তিনি এই দূরবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুজতে থাকেন।
৬০৫ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ((স.) এর বৈবাহিক জীবন ১০ বছর অতিবাহিত হলো। এই সময় বিবি খাদিজা রাঃ কে বিবাহ করার সুবাদে মহানবীর দারিদ্র্যতা দূর হয়। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর লাভবান হন। তবে তিনি ব্যবসার লভ্যাংশ দরিদ্র ও অসহায়দের দান করে দিতেন। মহানবী (স.) আরবের মক্কাবাসীর নিকট একজন সফল ব্যবসায়ি এবং আল আমিন তথা বিশ্বাসী হিসেবে সুপরিচিত লাভ করেন। কিন্তু মহানবীর সাঃ অর্থ-প্রতিপত্তি নই বরং তিনি সৃষ্টি ও স্রষ্টার রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে ভাবতে থাকেন।
আরবের অন্যান্য লোকেরা যখন নারী, মদ, জুয়া খেলা ইত্যাদি মাঝে ডুবে থাকতো, তখন মহানবী সঃ জীবনের আসল গন্তব্য এবং বিশ্ব জগতের রহস্য নিয়ে ভাবতেন। ৩৫ বছর বয়স থেকে বিশ্ব সৃষ্টি রহস্য জানার জন্য মহানবী সাঃ ব্যাকুলতা স্থায়ীরূপ লাভ করে। পবিত্র কা”বা থেকে তিন মাইল দূরে জাবালে নূর বা নূর পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় প্রতি একমাস বিশেষ করে রমজান মাসে তিনি ধ্যান ও প্রার্থনায় মন্গ থাকতেন। মহানবী এই গুহায় পতনোন্মুখ মানব জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের সন্ধান দিয়ে অধঃপতন হতে রক্ষার করার জন্য তিনি বিশিষ্ট মনে গভীর তপস্যায় নিমগ্ন থাকতেন।
হযরত মুহাম্মদ সঃ এর বয়স তখন ৪০ বছর। ৬০৫ থেকে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছরের রমজান মাসে হেরা গুহায় বসে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন তিনি। অবশেষে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসের শেষ দশকের একদিন বা ২৭ তারিখ শবে ক্বদর রাতে মহান আল্লাহর দূত ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আঃ মাধ্যমে মহানবীর কাছে ওহী তথা পবিত্র কুরআন নাযিলের সূচনা হয়।
উল্লেখ্য, যুগে যুগে আল্লাহ পাক মানুষের হেদায়েতের জন্য যেরূপভাবে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তদ্রূপ তাঁদের বিভিন্নজনের উপরে বিভিন্ন প্রত্যাদেশ নাযিল করে স্বীয় বিধানও তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন। আর এটাকেই ওহী বলা হয়। দীর্ঘ ২৩ বছর নাযীল হওয়া এই ওহী তথা আল্লাহর বিধি-বিধান সমূহের সামষ্টিক রূপেই হলো মহাগ্র্রন্থ আল কুরআন। অতঃপর জিবরাঈল আঃ মাহনবীর সামনে আবির্ভূত হয়ে দ্ব্যর্থকণ্ঠে বললেন,
“ইক্রা বিইস্মি রব্বিকালাজ্জি খালাক, খালাকাল ইন্সানা মিনআলাক, ইক্রা
ওয়া রাব্বুকাল্ আকরামুল্লাযায় আল্লামা বিল কালাম আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়া’লাম”
অর্থাৎ- পাঠ কর তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে, পাঠ কর আর তোমার রব্ মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছে মানুষকে যা সে জানত না “
এই ওহীর বাণী শুনে মহানবী সঃ এতই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে, প্রথম দু্ই বার চেষ্টা করেও তিনি ওহী উচ্চারণ করতে পারেননি। তৃতীয় বারে তিনি ঐশীবাণি পাঠ করে ঐশীজ্ঞান লাভ করেন। এবং ওহী তথা মহান আল্লাহর বিধান লাভের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীর মর্যদা লাভ করেন। মহানবী সঃ এর নবুয়ত লাভের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম নবী হযরত আদমঃ এর উপর অবতীর্ণ এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ইসলাম ধর্মের পুনরূত্থান ঘটে আরবের মক্কা নগরীতে।
প্রসঙ্গত, মহানবী সঃ এর পূর্ববর্তী প্রায় ২ লক্ষ ২৩ হাজার নবী-রাসূলগণ ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রচারক এবং অনুসারি। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু কিছু জাতি ইসলাম ধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের মত করে ধর্মমত তৈরি করে তার উপর অবিচল থাকে। তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য দুইটি জাতি হলো ইহুদি এবং খ্রিস্টান। হযরত মূসা আঃ ছিলেন ইসলামের নবী, কিন্তু তার অনুসারি বনি ইসরাইল জাতি পথভ্রষ্ট হয়ে ইসলামকে ত্যাগ করে ইহুদি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।
অপরদিকে, হযরত মুহাম্মদ সঃ এর ঠিক পূর্ববর্তী নবী ঈসা আঃও ইসলাম ধর্ম তথা একাত্ববাদ প্রচার করেছিলেন, কিন্তু তার অনুসারী নাসায়ী জাতি ইসলামকে ত্যাগ করে খ্রিস্ট ধর্ম তথা ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে। তাছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ মানবজাতী ইসলাম ধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে মহান আল্লাহর পরিবর্তে সম্রাট কিংবা পাথরে মূর্তির প্রার্থনা করতে থাকে। পরিশেষে সমগ্র মানবজাতিকে এই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে পরিচালনার জন্য মহান আল্লাহ মুহাম্মদ সঃ কে ইসলামের শেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।
ইসলাম ধর্ম যেমন মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম, তেমনি এই ধর্মের অনুসারী মুসলমানরা হলো পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্বকারী মহান রবের মনোনীত একমাত্র জাতি। তাই যুগে যুগে মানবজাতী ইসলামের ছায়াতলে এসে সত্যের আলোতে আলোকিত হয়েছে, এবং মানবজাতীর মাঝে যারা প্রকৃত বুদ্ধিমান তারা এখনো প্রতিনিয়ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে, আর এই আলোর পথের যাত্রীদের সংখ্যা দিন দিন এভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
প্রসঙ্গত, অমুসলিম ঐতিহাসিক এবং তথাকথিত ইতিহাসবেত্তারা বলে থাকেন, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ সঃ। কিন্তু এটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত মতবাদ। কেননা যদি মহানবী (স.) কে ইসলামের প্রবর্তক বলা হয়, তা হলে তার পূর্ববর্তী প্রায় ২ লক্ষ ২৩ হাজার নবী রাসূলদের অস্বীকার করা হবে। মূলত অমুসলিমরা বিশেষ করে পাশ্চাত্যের ইহুদি, খ্রিস্টানরা মনে করে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ সঃ, তাই তারা মহানবী (স.) কে আল্লাহর নবী হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ পাই।
পরবর্তী অংশ পড়ুন : মহানবীর (সঃ) গোপনে ইসলাম প্রচার : মক্কায় প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন যারা ।
তথ্যের উৎস সমূহ:
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান
৩. ইসলামের ইতিহাস ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
0 মন্তব্যসমূহ