মুহাম্মদ (সঃ) এর বেদনাময় শৈশবকাল |

                                     

          পূর্বের অংশ পড়ুন : মহানবী (সঃ) এর জন্ম ও বংশ পরিচয় ।

যে মহামানব না হলে এ ধরা পৃষ্ঠের কোন কিছুই সৃষ্টি হত না, যার পদচারণে এই পৃথিবী ধন্য হয়েছে।আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, ধৈর‌্য, ক্ষমা, সততা, নম্রতা, আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ। যিনি ছিলেন একাধারে- ইয়াতিম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহময়, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত, যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, মহৎ রাজনীতিবিদ এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক, তিনি হলেন সর্বকালের সর্বযুগের এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন সমগ্র পৃথিবী ও আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল। অতঃপর ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার প্রত্যুষে আরবের মক্কা নগরীতে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে বিবি আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের ৫ মাস পূর্বে মহানবী সাঃ এর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।  জন্মের পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ অর্থাৎ প্রশংসিত এবং মাতা আমিনা রাখেন আহম্মদ অর্থাৎ চরম প্রশংসাকারী। এই দুটি নামই পবিত্র কুরআনে লিপিবদ্ধ আছে।

আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথা অনুযায়ী, জন্মের দুই সপ্তাহ পর নবজাতক শিশু মুহাম্মদ সঃ এর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বনী সাদ গোত্রের বিবি হালিমার উপর। এ সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্র সন্তান ছিল, যার দুধ পানের মুদ্দত তখনো শেষ হয়নি। বিবি হালিমা বর্ণনা করেন, “ শিশু মুহাম্মদ সঃ কেবলমাত্র আমার ডান স্তনের দুধ পান করত। আমি তাঁকে আমার বাম স্তনের দুধ পান করাতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না।

আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তার অপর ‍দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুধ পানের শেষ দিবস পর‌্যন্ত তাঁর এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল। ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়ে দিয়েছেন। দুধ মাতা হালিমার ঘরে থাকাকালীন এক অলৌকিক ঘটনাবলে দুজন ফেরেশতা শিশু মুহাম্মদ সঃ এর বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর আত্মাকে শুদ্ধিকরণ করেন। বনি সাদ গোত্রে বিবি হালিমার গৃহে দীর্ঘ পাঁচ বছর অবস্থান করার ফলে মুহাম্মদ সঃ উৎকৃষ্ট আরবি ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত হন। এই কারণে পরে তিনি সগর্বে বলেন, “ নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরিপূর্ণ মানুষ। আমি কুরাইশ বংশোদ্ভুত হলেও বানু সাদের ভাষায় আমার মাতৃভাষা। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে দুগ্ধমাতা হালিমা রাসুল (সা.)-এর কাছে খুবই সম্মান পেতেন। মহানবী (সা.) নিজ গায়ের চাদর বিছিয়ে হালিমার জন্য আসন করে দিয়েছিলেন।

মাত্র পাঁচ বছর মুহাম্মদ সঃ দুধমাতা হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মাতা আমেনার গৃহে। ৬ বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা যান। কিন্তু মদীনা হতে প্রত্যাবর্তনের পথে আবহাওয়া নামক স্থানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাতা আমেনাও ইন্তেকাল করেন। আত্মীয়-স্বজন ও জনহীন প্রান্তরে বিবি আমিনার সঙ্গিনী দাসী উম্মে আইমান বহু কষ্ঠে সেই নির্জন মরুভূমিতে বিবি আমিনাকে কবর দিয়ে শিশু মুহাম্মদ সঃ কে নিয়ে কোনক্রমে মক্কায় ফিরে আসেন।

৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল মহানবী সঃ এর জীবনের একটি বেদনাদায়ক বছর, কেননা এই সময় তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গিয়েছিলেন। মাতা আমেনার ইন্তেকালের পর এতিম শিশুর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করলেন তৎকালীন মক্কার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা দাদা আব্দুল মুত্তালিব। ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে দাদা আব্দুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করলে চাচা আবু তালিব মক্কার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান এবং মুহাম্মদ সঃ এর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত হিসেবে, তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতীম এবং দুঃখ-বেদনার মধ্যে দিয়েই তিনি গড়ে উঠেন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং আমানতদারী হিসেবে। তার চরিত্র, আমানতদারী ও সত্যবাদীতার জন্য আরবের কাফেররা তাঁকে আল আমিন অর্থাৎ বিশ্বাসী ‍উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

পরবর্তী অংশ পড়ুন : মুহাম্মদ সঃ এর বাল্যকাল এবং সিরিয়া গমন ।

তথ্যের উৎস সমূহ:
১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান 
৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ