মুহাম্মদ (সঃ) এর বাল্যকাল এবং সিরিয়া গমন |

                                         

    পূর্বের অংশ পড়ুন :  মুহাম্মদ (সঃ) এর বেদনাময় শৈশবকাল ।

৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৬ বছর বয়সেই পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এতিম হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পিতা আব্দুল্লাহ এবং মাতা আমেনার মৃত্যুর পর শিশু মুহাম্মদ সঃ এর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করা পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব ও মৃত্যুবরণ করেন ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে। শিশু অবস্থায় পরিবারের সবচেয়ে কাছের আপনজনদের হারিয়ে মুহাম্মদ সঃ শোকে বিহবল হয়ে পড়েন।
কিন্তু মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে অভিভাবকহীন রাখলেন না। পিতামহ আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর মক্কার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বভার পড়ে মুহাম্মদ সঃ এর চাচা আবু তালিবের উপর। চাচা আবু তালিব বালক মুহাম্মদ সঃ এর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এতিম মুহাম্মদ সঃ চাচা আবু তালেবের স্নেহস্পর্শে লালিত হতে লাগলেন। কিন্তু চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না।
উল্লেখ্য, আবদুল মুত্তালিবের ধন সম্পদের পরিমাণ জীবনের শেষের দিকে কমে গিয়েছিল। মুত্তালিব মৃত্যুকালে যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা তেমন বেশি ছিল না। ১২ ছেলেদের মধ্যে সম্পদের বণ্টনের পর অল্প কিছু সম্পদ আবু তালিবের ভাগে ছিল। তাই বালক মুহাম্মদ সঃ কে জীবিকা নির্বাহের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হত। তিনি পার্শ্ববর্তী পর্বত ও উপত্যকায় মেষ-উট চড়িয়ে ছেলেবেলা হতে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে উঠেন। অবসর সময়ে তিনি কাবার তীর্থযাত্রীদের পানি সর্বারহ করতেন।
দারিদ্র্যতার জন্য তাঁর চাচা ভ্রাতুষ্পুত্রের লেখাপড়া শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করতে পারেন নি। কিন্তু বালক মুহাম্মদ সঃ মেষ ও উঠ চরাতে চরাতেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পরম পাঠগৃহেই শিক্ষার প্রথম সবক গ্রহণ করেন। আধুনিক অর্থে বিশ্ব-প্রকৃতিই ছিল তার শিক্ষক। যখন হজরতের বয়স মাত্র ৯ বছর তখন চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। এটাই রাসূল সা:-এর জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ।
সিরিয়া ভ্রমণ রাসূল সা:-এর জীবনে অনেক বড় ঘটনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা জ্ঞান এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য তার হৃদয়ে স্থান করে নেয়। আবু তালেবের কাফেলা এক প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র বসরা নামক স্থানে তাঁবু খাটায়। ওই তাঁবুর কাছে ছিল খ্রিষ্টানদের একটি গীর্জা। ওই গির্জায় ‘বুহাইরা’ নামক একজন জ্ঞানী পাদ্রি ছিলেন। সেই পাদ্রি ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘তাওরাত’ এবং খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থ ‘ইঞ্জিল’ থেকে শেষ নবীর লক্ষণ ও পরিচয় সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান রাখতেন।
গির্জার কিছু দূরে আবু তালেবের কাফেলা অবস্থান করছিল। পাদ্রি ‘বুহায়রা’ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ থাকার কারণে বুঝতে পারলেন আবু তালেবের বড় সফরসঙ্গী হিসেবে বালক মুহাম্মদ সা: সর্বশেষ নবী। তাই খ্রিস্টান পাদ্রি আবু তালেবকে কসম দিয়ে বললেন, ‘এই বালককে যত সত্বর সম্ভব সাবধানে দেশে পৌঁছে দিতে যত্নবান হোন।’ তিনি আরও বললেন, ‘সিরিয়া গেলে ইহুদিরা তাঁকে মেরে ফেলবে। এ বালক বড় হয়ে আল্লাহর নবী হবে। তাওরাতকে সে রহিত করে দেবে এবং ইহুদি ধর্মযাজকদের রাজত্বের অবসান ঘটাবে।’
পাদ্রি বুহায়রা বলেন, ধর্মীয় কিতাব তাওরাতে মহানবী (সা.)-এর পূর্ণ অবয়ব ও আকৃতির বিস্তারিত বিবরণ ইহুদিদের জানা ছিল। এ সময় একজন নবী আসবেন, তা-ও তারা জানত। তাই পৌত্তলিক বিরোধী বুহাইরা মুহাম্মদ সঃ কে ইহুদি রোষ হতে রক্ষার জন্য আবু তালেবকে সতর্ক করে দেন। আশঙ্কিত আবু তালেব সিরিয়া সফর সংক্ষিপ্ত করে মক্কায় ফিরে আসেন। এটাই ছিল মুহাম্মদ সা:-এর প্রথম ব্যবসায়িক সফর। এই সফরের ফলে মহানবী সঃ বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করেন এবং বাহিরের পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এই কাফেলার বাণিজ্যে আবু তালেব প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন।
ইতিহাসে ইহুদি পণ্ডিত বুহায়রা রাহিবই প্রথম, যিনি নবী হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন সংবাদ ব্যক্ত করেন। ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন, সিরিয়াগামী কাফেলার ওপর বুহায়রা এক খণ্ড মেঘ উড়তে দেখেছিলেন। পরে তিনি দেখতে পান, মেঘখণ্ড বালক মুহাম্মদকে ছায়া দিচ্ছে। পরে আসমানি কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী বুহায়রা বালক মুহাম্মদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিরীক্ষা করেন এবং দুই কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর অঙ্কিত দেখতে পান। (ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩)

তথ্যের উৎস সমূহ:

১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান 
৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ