পূর্বের অংশ পড়ুন : প্রাক ইসলামী আরবের ভৌগলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ।
রাজনৈতিক অবস্থা : প্রাক ইসলামী আরবের রাজৗনতিক অবস্থা ছিল অতীব নৈরাশ্যজনক ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। উত্তর আরবে বায়জানটাইন ও দক্ষিণে পারশ্য শাসিত কতিপয় রাজ্য ছাড়া সমগ্র আরবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গুলো স্বাধীন ছিল। শহরবাসী আরবগণের রাজনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভাল থাকলেও মরুবাসী আরবগণের রাজনৈতিক আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আরবে তখন আইন কানুন বলেতে কিছুই ছিল না।
আরবগণ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের দলপতিকে বলা হত শেখ। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় গোত্র-কলহ এক ভয়াবহ আকার ধারণ করত। কলহপ্রিয় আরব গোত্রগুলি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে লিপ্ত থাকত। প্রাক ইসলামী যুগে আরব গোত্রের যুদ্ধ বিগ্রহের অসংখ্য নজির পাওয়া যায়। মদিনায় আউস ও খাজরাজ নামক দুইটি গোত্রের মধ্যে সংঘটিত লড়াইকে বুয়াসের যুদ্ধ বলা হয়।
উল্লেখ্য, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী সঃ এর মদীনায় হিজরতের পূর্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছাড়া মক্কার কুরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রদ্বয়ের মধ্যে হারবুল ফিজার যুদ্ধ ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে মহানবী সাঃ এর বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। তাছাড়া একটি উটকে কেন্দ্র করে চল্লিশ বছরব্যাপি বানু বকর ও বানু তাঘলিব গোত্রের মধ্যে যে বসুসের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা প্রায় ৪০ বছর স্থায়ী হয়েছিল।
আরও পড়ুন : মহানবীর (স) মদিনা হিজরত।
ঘোড়া দৌড়ের সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবস ও জুবাইন গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধ প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ঐতিহাসিক গীবনের মতে, অজ্ঞাতার যুগে আরবে প্রায় ১,৭০০ যুদ্ধ-বিগ্র সংঘটিত হয়। তবে মক্কা ও এর শহরতলি এলাকায় রাজনীতির উন্মেষ দেখা যায়। বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় গুরত্বের কারণে এখানে ক্রমে এক নগররাষ্ট্রের সূত্রপাত ঘটে। মক্কার প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য, বিভিন্ন কুরাইশ গোত্রপতিদের নিয়ে গঠিত হয় একটি মন্ত্রণা পরিষদ যা মালা নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, মহানবী সঃ এর জন্মের সময় এই মক্কা নগর রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, মহানবী সঃ এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব।
ধর্মীয় অবস্থা: হযরত আদম আঃ থেকে হযরত ঈসা আঃ পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ মানব সমাজে আল্লাহর একত্ববাদ তথা ইসলাম প্রচার করে প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু ঈসা আঃ এর ইন্তেকালের পর সমগ্র বিশ্বের মত আরব বিশ্বও ঘোর পৌত্তলিকতায় ফিরে যায়। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ সঃ এর জন্মগ্রহণের পূর্বে আরবের ধর্মীয় জীবন অন্ধাকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
প্রাক ইসলামী যুগে আরবে মোটামুটিভাবে চার প্রকার ধর্মাবলম্বী লোক বাস করত। তারা হলো, ইহুদি, খ্রিস্টান, প্রকৃতি পূজক ও মূর্তি উপাসক আরববাসী এবং হানিফ সম্প্রদায়। ইহুদিগণ মূসা আঃ প্রবর্তিত ইসলামকে বিকৃত করে, অজ্ঞানতাবশত জোহাবকে বিশ্ব জগতের স্রষ্টা মনে করত। অপর পক্ষে খ্রিস্টানরা ঈসা আঃ প্রবর্তিত ইসলামের একাত্ববাদের পরিবর্তে ত্রিত্ত্ববাদে বা তিন খোদায় বিশ্বাসী ছিল। তদের মতে আল্লাহর স্ত্রী ছিলেন বিবি মরিয়ম, এবং ঈসা আঃ ছিলেন আল্লাহর ছেলে (নাউজিবিল্লাহ)।
আরও পড়ুন : মহানবীর (স) মক্কা বিজয়
ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম আরবের নৈতিক ও পার্থিব অবস্থার উপর কোন প্রকার মঙ্গলজনক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বাকি সমগ্র আবরবাসী ছিল মূর্তি উপাসক এবং প্রকৃতি পূজারী। তারা ইচ্ছানুযায়ী দেব-দেবী প্রস্তুত করে সেগুলোর পূজা করত এবং চন্দ্র, সূরর্য, নক্ষত্র, প্রস্তর খন্ড এবং বৃক্ষরাজিকেও পূজা করত। এমনকি যে কাবাগৃহ ইব্রাহীম আঃ একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি করেছিলেন, সে কাবাগৃহে পৌত্তলিক আরববাসী কালক্রমে ৩৬০ টি দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করেছিল।
উল্লেখ্য, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সঃ) বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের সময় কাবায় প্রতিষ্ঠিত এই মূর্তি গুলো ভেঙ্গে চূরমার করে ফেলেন। তবে এই ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগেও আরবের মদিনা নগরীতে মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা কোনপ্রকার মূর্তি পূজা করতো না এবং স্বতন্ত্র জীবনযাপন করতেন। পৌত্তলিক আরবে তারা হানিফ নামে পরিচিত ছিল। বিবি খদিজা রাঃ এর চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফাল, বিখ্যাত কবি যুহাইর প্রমুখ বিশিষ্ট আরববাসিগণ ছিলেন একেশ্বরবাদী হানিফ সম্প্রদায়ের।
পরবর্তী অংশ পড়ুন : আবারাহা বাদশাহের কাবা আক্রমণ ও পরাজয়ের ইতিহাস
তথ্যের উৎস সমূহ:
১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।
২. ইসলামের ইতিহাস - মোঃ মাহমুদুল হাছান
৩. ইসলামের ইতিহাস ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট ।
0 মন্তব্যসমূহ