দক্ষিণ আরবের প্রাচীন রাজ্যসমূহের পরিচিতি |

                      পূর্বের অংশ পড়ুন : আরবজাতির উৎপত্তি ও নামকরণ ।
ইসলামের ইতিহাসের সাথে আরব জাতির যেমন গভীর সম্পর্ক রয়েছে তেমনি প্রাচীন আরবের রাজ্যসমূহও একই সূত্রে গাঁথা। তাছাড়া ইসলামের ইতিহাস ভালোভাবে বুঝতে কিংবা জানতে প্রাচীন আরবের রাজ্যসমূহ সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনকালে সমগ্র আরব ক্ষুদ্রক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এই রাজ্যসমূহ সর্বদা একে অপরের সাথে যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত থাকতো। ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন আরবের রাজ্যসমূহকে দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- দক্ষিণ আরবের রাজ্যসমূহ এবং উত্তর আরবের রাজ্যসমূহ।

ঈসা আঃ এর জন্মেরও বহু বছর পূর্বে দক্ষিণ আরবে সাবা, মিনীয়, কাতাবান,হাযরা মাউৎ নামক ৪ টি রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। তাছাড়া পরবর্তীতে সাবিয়ান ও মিনাইয়ান সভ্যতার উপযুক্ত উত্তারাধিকারী হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ অব্দে ৩০০ খ্রিস্টাব্দে পর‌্যন্ত দক্ষিণ আরবে হিমাইয়ারী রাজবংশ রাজত্ব করে। এরাই আরব উপদ্বীপে সর্বপ্রথম নগর সভ্যতার গোড়াপত্তন করে। নিম্নে দক্ষিণ আরবের রাজ্যসমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

সাবা রাজ্য: ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের দ্বারা জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যেই সাবেয়ীগণ ‘সাবা’ রাজ্যের পত্তন করে। আরব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সেমিটিক জাতিভুক্ত এই সাবেয়ীগণই সর্বপ্রথম আরব উপদ্বীপে সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়। হাজরামাউত ও ইয়ামেন অঞ্চলই প্রধানত সাবা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের রাজধানী ছিল ‘মারিব’। এবং তাদের উজ্জ্বলতম কৃতিত্ব হলো- মারিব বাঁধ নির্মাণ ।

আরও জানো : প্রাচীন আরবের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা

মিনীয় রাজ্য: সাবা রজ্যের পাশে মা’আন নামক স্থানে মিনীয়গণও একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।মিনীয়গণ সাবেয়ীদের প্রতিদ্বন্ধী ছিল। তাদের রাজধানী ছিল ‘কারনব‘। কারনবের বর্তমান নাম মাইন, এটি ইয়ামেনের রাজধানী সানার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। কিন্তু সাবেয়ীগণ উন্নত সভ্যতার অধিকারী হওয়ায়, মিনীয়দের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। কালক্রমে মিনীয় রাজ্য সাবেয়ী রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়।  

কাতাবান ও হাজরামাউৎ রাজ্য: সাবেয়ী এবং মিনীয়গণ ব্যাতিত আদনের পূর্বদিকে কাতাবান এবং বর্তমান হাযরা মাউতে হাযরামউৎ নামক পৃথক পৃথক দুইটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। কাতাবানের রাজধানী ছিল কাহলান এবং হারামাউতের রাজধানী ছিল শাবওয়াহ। কাতাবান রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যন্ত। এবং হাযরামাউত রাজ্যের স্থায়িত্ব কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দে পর‌্যন্ত।

হিমায়েরী রাজ্য: সাবিয়ান ও মিনাইয়ান সভ্যতার উপযুক্ত উত্তারাধিকারী হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দে পর‌্যন্ত দক্ষিণ আরবে হিমাইয়ারী রাজবংশ রাজত্ব করে। হিমায়েরীদের রাজধানী ছিল ইয়ামেনের ‘জাফরা’ নামক স্থানে। এই রাজ্যের প্রধান উল্ল্যেখযোগ্য ঘটনা হলো আবিসিনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন। যদিও পরবর্তীতে আবিসিনিয়গণ হিমায়েরী রাজ্যকে দখল করে। ৩০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হিমায়েরী রাজ্যের পতনের পর দ্বিতীয় হিমায়েরী রাজত্বের সূচনা হয় এবং ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যন্ত রাজ্যেটি স্থায়ী ছিল। দ্বিতীয় হিমায়েরী যুগে সর্বপ্রথম ইয়ামেনে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম বিস্তার করে।

আরও পড়ুন: আরবের রাজনৈতিক অবস্থা।

৫২৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাটের ছত্রছায়ায় আবিসিনিয়ার খ্রিস্টানরা হিমাইয়ারী রাজ্য ইয়ামেন তথা দক্ষিণ আরব জয় করে এবং তারা ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর‌্যস্ত রাজত্ব করতে থাকে। এ যুগের সমসাময়িক বর্তমান ইয়ামেনের রাজধানী সানায় খ্রিস্টান শাসক আবরাহা মক্কার পবিত্র কা’বা শরীফের প্রতিদ্বন্দ্বীস্বরূপ আল ফালিস’ নামক প্রসিদ্ধ একটি গীর্জা নির্মাণ করেন। কিন্তু মক্কার কা’বা শরীফের গৌরব নষ্ট করতে ব্যার্থ হয় । ফলে আবারাহা হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মলগ্নে ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরী ও পবিত্র কা’বা শরীফ আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া মারি’বের বাধ ধ্বংসও আবারাহার অপর একটি দুষ্কর্ম।

পরবর্তীতে পারস্যের সম্রাট নওশেরওয়ারের সাহায্যে হিমাইয়ারী বংশের জৈনক সাইফ-ইবনে-জিইয়াযান ৫৭৫ সালে ইয়ামেনকে আবিসিনিয়ার শাসন হতে মুক্ত করে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই পারশ্যের সম্রাট সমগ্র দক্ষিণ আরব নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করে। এর ফলে ইসলামের ইতিহাসের গতিধারা ইয়ামেনের পরিবর্তে হেজাজ তথা বর্তমান মক্কা-মদীনা শহরে নির্ধারিত হতে থাকে।

পরবর্তী অংশ পড়ুন : প্রাচীন উত্তর আরবের রাজ্যসমূহ এবং মক্কার নেতৃত্ব ।

তথ্যের উৎস সমূহ:

১. আরব জাতির ইতিহাস - শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ।

২. ইসলামের ইতিহাস - হাসান আলী চৌধুরী

৩. ইসলামের ইতিহাস  ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হক ।

৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগের পোস্ট ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ