এই বংশের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন শ্রীগুপ্ত। কিন্তু শ্রীগুপ্ত ও তার পুত্র ঘটোৎকচ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে ঘটোৎকচের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত এবং পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বাংলা সহ ভারতে একটা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল মগধের পাটলিপুত্র তথা পাটনা। যা মৌর্য সাম্রাজ্যেরও রাজধানী ছিল।
![]() |
মগধ |
গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। কোন ঐতিহাসিকের মতে, গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল মগধে। তবে ঐতিহাসিক ডি.সি গাঙ্গুলির মতে, তাদের আদি বাসস্থান ছিল বাংলাদেশে। ভারতবর্ষে গুপ্তবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তিনি ৩২০ সালে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৩৪০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাকে প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ন বলা হয়।
আরও পড়ুন:বাংলায় পাল শাসনের উত্থান ও পতন
উল্লেখ্য, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যখন ভারত বর্ষে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন বাংলায় কতগুলো স্বাধীন রাজ্য ছিল। আর তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। তিনি সমতট ছাড়া বাংলার অন্যান্য জনপদগুলো নিজের সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকৃত বাংলার রাজধানীও ছিল পুন্ড্রনগর।
সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ৩৮০ সালে পাটালিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। তিনি মালবের উজ্জয়িনীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। অনেক প্রতিভাবান ও গুণী ব্যক্তি তার দরবারে সমবেত হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্যভট্ট এবং জ্যোতির্বিদ মিহির। ৪১৬ সালে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মৃত্যবরণ করার পর তার পুত্র কুমারগুপ্ত সম্রাট হন।
![]() |
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত |
ধারণা করা হয়, সমতট অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সময় স্বাধীনরাজ্য হিসেবে থাকলেও পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তা গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। গুপ্ত যুগে বাংলায় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বৌ্দ্ধ ও জৈনধর্মের প্রসার চলমান থাকলেও গুপ্ত সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সময়ে হিন্দু ধর্মের উত্থান ও প্রসার ঘটে। বাংলাদেশ গুপ্তযুগে উত্তর ভারতের রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতির ধারার সংগে যুক্ত হয়।
আরও পড়ুন:বাংলায় পাল শাসনের উত্থান-পতন
বাংলাদেশের যে সব স্থানে গুপ্তদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল, গুপ্ত সম্রাট সেগুলোকে শাসনকার্যর সুবিধার জন্য কয়েকটি বিভাগ ভাগ করেছিল। এই সব বিভাগের নাম ছিল ভুক্তি, যেমন- বর্ধমান ভুক্তি, পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি ইত্যাদি। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, দামোদর গুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। সম্ভবত তার সময়ে অর্থাৎ ষষ্ট শতকে উত্তরভারতের অন্যান্য স্থানের মত বাংলায়ও গুপ্তশাসনের পতন হয়।
![]() |
যশোবর্ধন |
বাংলায় গুপ্ত শাসনের পতনের প্রধান কারণ ছিল বৈদেশিক আক্রমণ। বহুকাল হতে পশ্চিম ভারতে অবিরাম হুন আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি যথেষ্ট পরিমাণ হ্রাস প্রাপ্ত হয়েছিল। অবশেষে আনুমানিক ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে হুনদের আক্রমণের টুকরো টুকরো হয়ে যায় গুপ্ত সাম্রাজ্যে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের যুগে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে পশ্চিম ভারতে যশোধর্মন নামক একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও নরপতির অভ্যুদয় ঘটে।
তিনি হুনরাজ মিহিরকুলকে পরাজিত করে হুনদের অগ্রগতি রোধ করেন। পরবর্তীতে যশোধর্মন সমগ্র উত্তর ভারত দখল করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। তার অভিযানের ফলে বাংলায় গুপ্ত শাসনের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য, যশোধর্মনের কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী না হলেও গুপ্তশাসনের আর পুনরুদ্ধার হয় নাই।
0 মন্তব্যসমূহ