প্রাচীন বাংলার জনপদসমূহ |

প্ৰাচীনযুগে বাংলা নামে কোনো অখণ্ড রাষ্ট্ৰ ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্তছিল। প্রাচীনকালে বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই অঞ্চলগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল জনপদ। চতুর্থ শতক হতে গুপ্ত যুগ, গুপ্ত পরবর্তী যুগ, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের উৎকীর্ণ শিলালিপি ও সাহিত্য গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার ১৬ টি জনপদগুলোর নাম পাওয়া যায়।

যাদের মধ্যে বঙ্গ, পুৃন্ড্র, গৌড়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র,রাঢ়,চন্দ্রদ্বীপ ইত্যাদি জনপদ গুলোর সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত। বাংলার বিভিন্ন অংশে অবস্থিত প্ৰাচীন জনপদগুলোর সীমা ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। কেননা বিভিন্ন সময়ে এসব জনপদের সীমানা হ্ৰাস অথবা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে প্ৰাচীনতম হলো পুন্ড্র। নিন্মে প্রাচীন বাংলার জনপদগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপতা করছি।

পুন্ড্র: বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জনপদ হলো পুন্ড্র। বর্তমানের বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অবস্থানভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পুণ্ড্র জনপদ। প্রাচীন পুণ্ড রাজ্যের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। 
এই জনপদের বর্তমান অবস্থান বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়। উল্লেখ্য, পুন্ড্র জনপদ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো- বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্র- পুণ্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড়। বিখ্যাত সাধক শাহ-সুলতান বলখির মাজার অবস্থিত- মহাস্থানগড়ে। বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর অবস্থিত- মহাস্থানগড়ে।
                                                  
পুন্ড্রবর্ধন

আরও পড়ুন:বাংলাদেশ - এর নামকরণের ইতিহাস

গৌড : প্রাচীন বাংলার জনপদ গুলোকে রাজা শশাঙ্ক গৌড় নামে একত্রিত করেন। পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে এ জনপদের শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ  এর সন্নিকটের এলাকা গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আধুনিক এ মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ গৌড়ের সীমানা মনে করা হয়।

বঙ্গ: আধুনিক বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল, পাবনা, ফরিদপুর নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি এবং পশ্চিমের উচ্চভূমি যশোর, কুষ্টিয়া, নদীয়া, শান্তিপুর ও ঢাকার বিক্রমপুর সংলগ্ন অঞ্চল ছিল বঙ্গ জনপদের অন্তর্গত। পাঠান আমলে সমগ্র বাংলা বঙ্গ নামে ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রাচীন বঙ্গ ছিল একটি শক্তিশালী রাজ্য। ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সমতট:  চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণ অনুযায়ী সমতট ছিল বঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বাংশের একটি নতুন রাজ্য। মেঘনা নদীর মোহনাসহ বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল সমতটের অন্তর্ভুক্ত। কুমিল্লা জেলার বড় কামতা সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে জানা যায়। কুমিল্লা ময়নামতিতে পাওয়া প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম ‘শালবন বিহার।                 

শালবন বিহার

আরও পড়ুন:বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি রাজা শশাংকের উত্থান ও পতন ।

রাঢ়:  রাঢ় বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীর হতে গঙ্গা নদীর দক্ষিণাঞ্চল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। অজয় নদী রাঢ় অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। উত্তর রাঢ় বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা দক্ষিণ রাঢ় বর্ধমানে দক্ষিণাংশ হুগলি বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা।

হারিকেল : সপ্তম শতকের লেখকেরা হরিকেল নামে একটি জনপদের বর্ণনা করেছেন। চীনা ভ্রমণকারী ইৎ সিং বলেছেন, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের শেষ সীমায়। ত্রিপুরার শৈলশ্রেণির সমান্তরাল অঞ্চল সিলেট হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হরিকেল বিস্তৃত। অর্থাৎ বর্তমান চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল হারিকেল জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আরও পড়ুন:বাংলায় সেন রাজবংশের পতন ও মুসলিম শাসনের উত্থান।

চন্দ্রদ্বীপ: আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে উল্লেখিত বাকলা পরগণা বর্তমান বরিশাল জেলার অন্তর্গত। মধ্যযুগে বর্তমানে বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। বরিশাল ও আধুনিক পটুয়াখালী, মাদারীপুর, গোপালগন্জ, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চল ও এই প্রাচীন জনপদের অন্তুর্ভুক্ত ছিল।

বরেন্দ্র : বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রভূমি নামে প্রচীন বাংলায় অপর একটি জনপদের কথা জানা যায়। এটিও উত্তর বঙ্গের একটি জনপদ। আধুনিক বগুডা, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেকটা অঞ্চল এবং সম্ভবত পাবনা জেলা জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বিস্তৃত ছিল। উল্লেখ্য, উপরিউক্ত জনপদগুলো ছাড়াও তাম্রলিপ্ত, অঙ্গ, বর্দ্ধমানভুক্তি, কঙ্কাগ্রামভুক্তি, বারকমন্ডল, শ্রীহট্টমন্ডল, কজঙ্গল ইত্যাদি  জনপদগুলোর অবস্থান বর্তমান ভারতে।

পরবর্তী অংশ পড়ুন : প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে বাংলায় গুপ্ত শাসনের সূচনা ।

                                                     ভিডিও দেখুন : 

  • তথ্যের উৎস সমূহ:
  • প্রাচীন বাংলার ইতিহাস – ড. মোঃ শাহজাহান ।
  • বাংলার ইতিহাস – ড. সুণীতি ভূষণ কানুনগো।
  • বাংলাদেশের ইতিহাস - অধ্যাপক কে. আলী।
  • উইকিপিডিয়া এবং বাংলাপিডিয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ